আল-আকসার তুফান ও ভারতের একচোখো ইসরাইল-প্রীতি: একটি বহুমাত্রিক পর্যালোচনা

By Hossain Mohamed Naimul Hoque

Ibn Khaldon Center, Qatar University

 

চলতি মাসের ৭ তারিখে ঘটিত আল-আকসার তুফানের ফলাফল মোটামুটি সবার জানা। হামাসের প্রতিরোধ-শাখা আল-কাস্সাম ব্রিগেড কর্তৃক অতর্কিত বেশকিছু দখল.দার ইসরাইলী শহরে ঢুকে পড়া, শতাধিক দখলদার সৈন্যকে হত্যা করা, আরো শতাধিক সৈন্যকে বন্দি করা এবং কয়েকশ সৈন্য আহত হওয়া ইত্যাদি বিষয়ে মোটামুটি সবাই অভিহিত। তবে দীর্ঘ প্রায় ১৭ বছর ধরে অবরুদ্ধ একটি উপত্যকায় অবস্থানকারী পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন একটি দলের হাতে মধ্যপ্রাচ্যের কথিত সবচেয়ে শক্তিশালী বাহিনীর সদস্যদের মুহূর্তে ধরাশায়ী হওয়ার ঘটনা— ইসরাইল ও তার পশ্চিমা বন্ধু দেশগুলোকে অস্থির করে তুলে। ঘটনার প্রভাব ও আকস্মিকতা এসব দেশের সামরিক বিশেষজ্ঞদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়। এবং পশ্চিমা রাজনীতিবিদদের ঘোর কাটতে সময় লাগে। সময়ের সাথে ধীরে ধীরে ঘোর কাটা শুরু হলে— ইসরাইলের প্রতি তাদের সংহতি প্রকাশের মিছিল শুরু হয়। আমেরিকা, ব্রিটেন ও জার্মানিসহ প্রায় সব পশ্চিমা রাষ্ট্র ইসরাইলের প্রতি একচ্ছত্র সহমর্মিতা প্রকাশ করতে থাকে এবং সবধরনের সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। 

পশ্চিমা-দুনিয়ার বাইরে থেকে সম্ভবত ভারতই প্রথম ইসরাইলের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে। ঘটনার পরপর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী তার ভেরিফাইড এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে ইসরাইলের প্রতি সলিডারিটি ও সংহতি প্রকাশ করে। হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ভারতের মূলধারার গণমাধ্যমে তোড়জোড় শুরু হয়। ইসরাইলের প্রতি তাদের সংহতি প্রকাশের ধরন, দেশটির বিভিন্ন শহরে শোকমিছিল বের হওয়া, কোনো কোনো মন্দিরে পূজা-অর্চনা হওয়া, ভারতীয় উগ্র হি.ন্দু টুইটার ব্যবহারকারীদের ইসরাইলের প্রতি অন্ধভক্তি, ফিলিস্তিন ও হা.মাসের প্রতি তাদের তীব্র ঘৃণা, ভিত্তিহীন গুজব ছড়ানো ও সর্বোপরি ঘটনার পরে কয়েকদিন ধরে (#IndiaIsWithIsrael) হ্যাশট্যাগ টুইটারে ট্রেন্ডে চলে আসা এবং ভারতীয় বিভিন্ন উগ্রপন্থী হিন্দু সংঘটিত গোষ্ঠীর ইসরাইলে গিয়ে হা.মাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ গ্রহণের ইচ্ছা প্রকাশ— ইত্যাদি কারণে অনেকের মনে প্রশ্ন তৈরি হয়- হা.মাস কর্তৃক ইসরাইল আক্রমণের ঘটনায় ভারত ও ভারতীয়দের এতো আগ্রহের রহস্য কী?

আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যের এই প্রশ্নের উত্তরে আলাদা আলাদা রিপোর্ট প্রকাশ করা হয়। এবং ভারত সরকার ও ভারতীয় উগ্র হিন্দুদের একচোখো ইসরাইল প্রীতির কারণ উদ্ঘাটনের প্রয়াস চালায়। তার একটি খোলাসা আলোচনা তুলে ধরি— বিগত ৮ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩ তারিখে নয়াদিল্লিতে অনুষ্ঠিত জি-২০টি শীর্ষ সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর (IMEC) উন্মোচন করেন। যা ভারত, মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপকে সংযুক্ত করার একটি বিশাল মাল্টি-বিলিয়ন অর্থনৈতিক প্রকল্প। প্রকল্পটিতে ভারতের পাশাপাশি সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ইসরাইল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, ফ্রান্স এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন অংশ নেয়। যার অধীনে ভারতের পশ্চিম উপকূলকে প্রথমে সমুদ্রপথে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে সংযুক্ত করা হবে। অতঃপর আরব আমিরাতকে রেলপথে সৌদি আরবের মাধ্যমে ইসরাইলের হাইফা বন্দরের সাথে সংযুক্ত করা হবে। পরবর্তীতে হাইফা থেকে পণ্যগুলো গ্রিসের পাইরাস বন্দরের মাধ্যমে ইউরোপের অন্যান্য শহরে পাঠানো হবে (দেখুন, Financial Express, September 10, 2023), এই প্রকল্পটি মূলত চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর সরাসরি বিকল্প হিসেবে প্রস্তুতকৃত— যার মূল লক্ষ্য চীনের মোকাবেলায় ভারতকে শক্তিশালী করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের স্বার্থ রক্ষা করা। (দেখুন, The Diplomat, 17th October, 2023)। 

ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর

এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই যে, এরূপ একটি মাল্টি-বিলিয়ন প্রকল্প ভারত সরকারের জন্য শুধু অর্থনৈতিক দিক থেকে নয়— ভূ-রাজনৈতিক দিক থেকেও বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে। তবে স্বাভাবিকভাবে এই বিশাল প্রকল্পকে ঘিরে বেশ কিছু প্রশ্ন সামনে আসে। যেমন- ভারতকে মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপের সাথে যুক্ত করার জন্য ভারতসহ অংশগ্রহণকারী দেশগুলো বাস্তবসম্মত প্রস্তুতি আছে কিনা? ভারত সরকার নিজেই এমন একটি বিশাল প্রকল্পের জন্য কী কী প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে?

এসব প্রশ্নের উত্তর থেকে চলমান আল-আকসার তুফান ইস্যুতে ভারত ও ভারতীয়দের ইসরাইল-প্রীতির রহস্য উদ্ঘাটিত হয়। বিষয়টি আরো স্পষ্ট করতে ভারত-ইসরাইল ঐতিহাসিক সম্পর্কের দিকে একটু ইঙ্গিত দেওয়া জরুরি। ১৯৪৮ সালে ব্রিটেনের নেতৃত্বে ভৌগোলিক সীমারেখাহীন ইসরাইল নামক রাষ্ট্র ঘোষণা দেওয়া হলে— এই অযৌক্তিক রাষ্ট্রের অস্তিত্ব নিয়ে পৃথিবী চারভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। 

১. ব্রিটেন ও তার মিত্র শক্তি— যারা তোতাপাখির মতো ভূমিহীন ইসরাইল রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়ে দেয়।

২. আরব, মুসলিম বিশ্ব ও স্বাধীন পৃথিবীর বিভিন্ন রাষ্ট্র— যারা এই অভিনব রাষ্ট্রের স্বাধীনতা স্বীকার করতে অস্বীকৃতি জানায়।

৩. কোনো কোনো রাষ্ট্র এই রাষ্ট্রের স্বাধীনতার বিষয়ে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকে।

৪. ইরসাইলের স্বাধীনতার বিষয়ে দ্বিধাভাব প্রকাশ করে।

উপরোক্ত ক্যাটাগরিগুলোর মাঝে ভারত ছিল দ্বিতীয় দলের রাষ্ট্র। শুধু তাই নয় ১৯৬৭ সালের ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে ভারত ইসরাইল বিরোধী শিবিরে সরব ছিল। যদিও কারো কারো ধারণা— ভারত তলে তলে ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক জারি রাখে। আরব দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখতে তা প্রকাশ্যে নিয়ে আসেনি। (মুসতফা শিলশ, সিএইএস, পহেলা মে, ২০২২)

১৯৭৩ সালের ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধে ভারত প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনকে সমর্থন করে। ১৯৭৫ সালে ইয়াসির আরাফাতের নেত্রৃত্বাধীন প্যালেস্টাইন লিভারেশন ওরগানাইজেশান (পিএলও)-কে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৮২ সালে পিএলওকে পূর্ণ কূটনৈতিক মর্যাদা দেয়। এককথায় বলা যায়, মুসলিম বিশ্বের বাইরে ভারত ছিল— ফিলিস্তিন ইস্যুতে অন্যতম সোচ্চার রাষ্ট্র। (সুবহি হাদীদী, আল-কুদস আল-আরবী, ১৭ অক্টোবর, ২০২৩)।

তবে ৯০ এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে ভারত সবচেয়ে নিকটতম সামরিক মিত্র হারায়। ফলে একটি শক্তিশালী সামরিক মিত্রের প্রয়োজন অনুভব করতে থাকে। যে মিত্রের মাঝে দুটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ থাকা জরুরি—

১. এই মিত্রের সাথে নতুন সুপার পাওয়ারের (যুক্তরাষ্ট্র) সুসম্পর্ক থাকতে হবে।

২. এই মিত্রের কাছে উন্নত সামরিক টেকনোলজি থাকতে হবে।

ভারতের কর্তা ব্যক্তিদের কাছে ইসরাইল হলো উপরোক্ত দুই গুণ-বিশিষ্ট রাষ্ট্র। তাই এই রাষ্ট্রের সাথে দীর্ঘদিনের সম্পর্কের ধরনে পরিবর্তন আসা জরুরি। সে হিসেবে ১৯৯২ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী নরসিংহ রাও -এর নেতৃত্বে ভারত-ইসরাইল কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে— যা দ্রুত গতিতে উন্নতি লাভ করতে থাকে। সেই হিসেবে ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদির নেত্রৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসার পর সংঘটিত ফিলিস্তিন-ইসরাইল যুদ্ধে প্রথমবারের মতো ভারত জাতিসংঘে ইসরাইলি বর্বরতার বিরুদ্ধে নিন্দা প্রকাশ করা থেকে বিরত থাকে; যা পরবর্তীতে সরাসরি ইসরাইলের পক্ষপাতিত্বে রূপ নেয়। (দেখুন, নাবিল আল-সাহলী, আল-জাজিরা, ৬ আগস্ট, ২০১৫)। 

বিশেষজ্ঞদের মতে ভারত-ইসরাইল সম্পর্ক সামরিক বিবেচনায় উন্নতি হলেও— তা সামরিক খাতে সীমাবদ্ধ থাকেনি। বরং খুব দ্রুত সাংস্কৃতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, টেকনোলজি ও গোয়েন্দা খাতকেও অন্তর্ভূক্ত করে। তাই ভারত-ইরসাইল সম্পর্ক ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তিতে পরিণত হয়। অনেকের মতে এই সম্পর্কোন্নয়নে রাষ্ট্রীয় স্বার্থের পাশাপাশি বিজেপির হিন্দুত্ব.বাদ ও ইসরাইলের জা.য়নবাদের অভূতপূর্ব মিল— প্রাণশক্তি হিসেবে ভূমিকা রাখে। ফলে ভারত ইসরাইলের কাছ থেকে স্থানীয়দের হটিয়ে বহিরাগতদের সেটেলমেন্টের শিক্ষা নেয়— যা কাশ্মীর ইস্যুতে সুস্পষ্ট হয়। (দেখুন, Hostile homelands: the new alliance between India and Israel, International Affairs, Volume 99, Issue 4, July 2023)।

১৯৯২ সালে ভারত-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার পর থেকে অন্য সব খাতের চেয়ে অর্থনৈতিক খাতই নাটকীয়ভাবে উন্নতি লাভ করে। ফলে ১৯৯২ সালের মাত্র ২০০ মিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য দিয়ে শুরু হওয়া অর্থনৈতিক সম্পর্ক ২০২৩ সালে এসে (সামরিক খাত বাদে) ১০.১ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়। (দেখুন, তেল আবিবে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের ওয়েবসাইট, India-Israel Economic and Commercial Relations)। তাছাড়া বিগত ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে ভারত ইসরাইলে ৭.৮৯ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করে, যা আগের বছর (২০২১-২০২২) মাত্র ১.৬ বিলিয়ন ডলার ছিল। অর্থাৎ মাত্র একবছরের ব্যবধানে ৭৭% রপ্তানি হার বৃদ্ধি পায়। (দেখুন, সুজা আফসার, Charts, How India-Israel trade ties have grown, ০৯ অক্টোরব, ২০২৩)।

তাছাড়া নিজেদের কৃষি ব্যবস্থাকে উন্নত করতে ভারত ইসরাইলের সহযোগিতা গ্রহণ করে, যার ফলে ভারত ও ইসরাইলের মাঝে বেশকিছু চুক্তি সম্পাদিত হয়। সেগুলোর আওতায় ইসরাইল ভারতের কৃষি ব্যবস্থার উন্নয়নে বেশ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে, যার মধ্যে নিম্নের বিষয়গুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য—

১. ইসরাইল ভারতে ২৯ টি কৃষি গবেষণা সেন্টার প্রতিষ্ঠা করে— যা অ্যাগ্রিটেক, ক্লিনটেক ও রিনিউএব্যল পাওয়ার টেকনোলজি উন্নত করতে কাজ করছে এবং এ পর্যন্ত প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার ভারতীয় কৃষককে ট্রেইনিং দেয়।

২. ইসরায়েলি শস্য সুরক্ষা সংস্থা ADAMA অ্যাগ্রিকালচারাল সলিউশনস গুজরাটে একটি ফর্মুলেশন প্ল্যান্ট এবং হায়দ্রাবাদে একটি গবেষণা ও উন্নয়নকেন্দ্র পরিচালনা করে। পাশাপাশি ইসরায়েলের ইভোজিন (Evogene) কোম্পানী ভারতীয় ধানের গুণগত মান ও ফলন বৃদ্ধি করতে ভারতীয় রাসি সিডস লিমিটেডের সাথে চুক্তি সম্পাদন করে।

৩. ২০১৮ সালে ভারতে ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর এন্টারপ্রেনিউরশিপ অ্যান্ড টেকনোলজি ও মেটা-ইনকিউবেটর (যা iCreate নামে পরিচিত)— ইসরায়েলি ইনোভেশন অথরিটির পরামর্শ ও সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত হয়। পাশাপাশি ২০১৮ সালে ভারতীয় এগ্রি-টেক স্টার্ট-আপ (Vyoda) এবং ইসরায়েলের স্টার্ট-আপ অ্যাগ্রোসোলার ইরিগেটিং সিস্টেমের মধ্যে একটি যৌথ অংশীদারিত্ব চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তির অধিনে কৃষি ও স্টার্ট-আপ উন্নয়নে ইসরায়েলি দক্ষতাকে কাজে লাগাতে ভারতীয় একটি কোম্পানি তেল আবিবে একটি গবেষণা ও উন্নয়ন প্রকল্প চালু করে।

৪. ভারতীয় খামার সেচন পদ্ধতিকে উন্নত করতে ইসরায়েলি ড্রিপ ইরিগেশন সিস্টেম নির্মাতা মেটজার এবং ভারতীয় পাইপলাইন নির্মাতা স্কিপার এর ৫০-৫০% মালিকানাধীন একটি উৎপাদন ইনিশিয়েটিভ প্রতিষ্ঠা করে। ইসরায়েলি এই প্রযুক্তি ভারতের ক্রমবর্ধমান পানিসংকট মোকাবেলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। (দেখুন, Michael Tanchum, The India-middle east food corridor: How the UAE, Israel, and India are forging a new inter-regional supply chain, জুলাই ২০২২)।

এছাড়াও ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে ভারতীয় জনতা পার্টি ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ইসরাইল-ভারত সম্পর্ক লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে। আল-জাজিরার এক রিপোর্ট মতে ওই বছর থেকে ভারত এশিয়ার মধ্যে ইসরাইলের তৃতীয় বৃহত্তর ব্যবসায়ী অংশীদার এবং পৃথিবীর দশম বৃহত্তর ব্যয়সায়ী অংশীদার দেশ। পক্ষান্তরে তেল আবিবে অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসের তথ্য মতে ভারত এশিয়া মহাদেশে ইসরাইলের ২য় বৃহত্তর এবং পৃথিবীর ৭ম বৃহত্তর ব্যবসায়ী অংশীদার রাষ্ট্র। (দেখুন, India-Israel Economic and Commercial Relations)।

তাছাড়া ইসরাইলের পৃথিবীর সর্ববৃহৎ সামরিক সরাঞ্জামাদি ক্রয়কারী দেশ হলো ভারত। ৪৯% ভারতীয় সামরিক সরাঞ্জামাদি ইসরাইল থেকে আসে, যার পরিমাণ ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার; যা ইসরাইলের প্রতিরক্ষা রপ্তানীর প্রায় ১৫ শতাংশ। পাশাপাশি ইসরাইলি সেনাবাহিনী ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা উন্নয়নে বেশ ভূমিকা রাখে এবং উভয় দেশের গোয়েন্দাসংস্থা পরস্পরের মধ্যে গোপন তথ্য আদান-প্রদান করে থাকে। (দেখুন, মুসতফা শিলশ, সিএএস, পহেলা মে, ২০২২; Amos Harel, Israel-India Strategic Ties Are No Longer a Secret, ১৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৫)।

তাছাড়া মোদী ক্ষমতায় আসার পর থেকে ভারত-সংযুক্ত আরব আমিরাত সম্পর্কও বাড়তে থাকে। সেই হিসেবে ২০১৭ সালে দুই দেশের মধ্যে ১৪টি কম্প্রিহেনসিভ স্ট্রাটেজিক পার্টনারশীপ (CSP) চুক্তি সম্পাদিত হয়। এসব চুক্তির অধীনে আরব আমিরাত ভারতে ১০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগের আশ্বাস দেয়। যার মধ্যে ২ মিলিয়ন ডলার ইতিমধ্যে ভারতীয় বিভিন্ন ফুড-পার্কে বিনিয়োগ করা হয়। এভাবে ভারত-ইসরাইল এবং ভারত-ইউএই সম্পর্ক ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর (IMEC) করিডোরের অনেকটুকু কাজ সহজ করে দেয়। তবে এগুলোকে ব্যবহার করে IMEC প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়— যা ইউরোপ পর্যন্ত বর্ধিত হওয়া জরুরি; যদি না ইসরাইল ও আরব আমিরাতের মাঝে সুসম্পর্ক তৈরি করা সম্ভব না হয়। সে হিসেবে ১৩ই আগস্ট ২০২০ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে সংযুক্ত আরব আমিরাত-ইসরাইল সম্পর্ক স্বাভাবিকরণ চুক্তি (আব্রাহাম অ্যাকর্ড) সম্পাদিত হয়। (দেখুন, রয়টার্স, ১৩ই আগস্ট, ২০২০)।

এই চুক্তি সম্পাদনের মাত্র একবছরে আরব আমিরাত ও ইসরায়েল বাণিজ্যের পরিমান ২.৪৫ বিলিয়নে পৌঁছে, যা আগামীতে আরো দ্রুত গতিতে বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে।

এভাবে ভারত-আমিরাত অর্থনৈতিক চুক্তি এবং ইসরাইল-আমিরাত অর্থনৈতিক চুক্তিকে কাজে লাগিয়ে তিন দেশের মধ্যে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য খাদ্য করিডোর প্রকল্প তৈরি করা হয়, যা ১৪ই জুলাই ২০২২ সালে ইসরাইলে অনুষ্ঠিত I2U2 শীর্ষ সম্মেলনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

যেহেতু ভৌগলিক দিক থেকে ভারত ও ইসরাইল বহুদূরে অবস্থিত। তাই এই দুই দেশের সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর (IMEC) তৈরি করা সম্ভব নয়। বরং ভারত ও ইসরাইলের মাঝামাঝি অবস্থানে থাকা দেশগুলোকেও এ ক্ষেত্রে কাজে লাগানো জরুরি।

কিন্তু সমস্যা হলো- এই দেশগুলোর সবগুলোই মুসলিম দেশ— যাদের সাথে ইসরাইলের কূটনৈতিক সম্পর্ক নেই। তাই এই দেশগুলো থেকে এমন কিছু দেশ নির্বাচন করা জরুরি— যারা ইসরাইলের সাথে সম্পর্কোন্নয়নে আগ্রহী। এ ক্ষেত্রে সংযুক্ত আরব আমিরাত হলো- সবচেয়ে উপযুক্ত দেশ। এই জায়গা থেকে ভারত সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্কোন্নয়নের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করে। যেহেতু IMEC প্রকল্পের মূল লক্ষ্য চীনের BRI এর বিকল্প তৈরি করা। তাই ভারত এই বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রেরও সহায়তা পায়। আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের সাথে যেহেতু ইসরাইলের সরাসরি জল বা স্থল পথ নেই। তাই সৌদি আরবের অংশ গ্রহণ ছাড়া এই চুক্তি কাগজের কালি ছাড়া আর কিছুই নয়। এই সমস্যা সমাধানকল্পে ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর (IMEC) প্রকল্পে সৌদি আরবকে সংযুক্ত করা হয়। সৌদির নিজস্ব স্বার্থ এবং যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহে সৌদি আরব এই প্রকল্পে অংশ গ্রহণ করে। এই লক্ষ্যে সৌদি আরব ইসরাইলের সাথে সম্পর্ক স্বাভাবিকরণের কাজ সম্পন্ন করে। (দেখুন, World Street Journal, Saudis Agree With U.S. on Path to Normalize Kingdom’s Ties With Israel, ৯ আগস্ট, ২০২৩)। ফলে আরব আমিরাতের সমুদ্র বন্দর থেকে সৌদি ভূমি ব্যবহার করে ভারতীয় পণ্য ইসরাইলের হাইফা বন্দরে পৌছানোর পথ সুগম হয়। (দেখুন, Jürgen Rüland & Elisabetta Nadalutti, Is the India-Middle East-Europe Economic Corridor Dead on Arrival? ১৭ই অক্টোরব, ২০২৩)। 

এভাবে ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, ইসরাইল, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ব্রিটেনের অংশ গ্রহণে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ অর্থনৈতিক করিডোর নির্মাণের সব প্রস্তুতি শেষ হয়। যেহেতু ভারতই হবে এই প্রকল্পের অধীনে মূল পণ্য সরবরাহকারী দেশ— তাই এই প্রকল্পকে কাজে লাগিয়ে ভারত বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের আশাবাদী। তাছাড়া প্রকল্পটির মাধ্যমে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পাশাপাশি ভারতের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্বও বহুগুণে বেড়ে যাবে। যা প্রতিবেশী শত্রু চীনকে ঘায়েল করতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

ভারত, ইউএই, সৌদি আরব, ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রসহ আরো কয়েকটি রাষ্ট্র মিলে যখন এই বিশাল পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার কাজে ব্যস্ত— ঠিক তখনই গাজা উপত্যকায় অবস্থানরত একটি অবরুদ্ধ গোষ্ঠী ইসরাইলে আক্রমণ করে। অর্থাৎ মোদী-কর্তৃক IMEC প্রকল্প ঘোষণার মাত্র একমাসের মাথায় হা.মাস ইসরাইলে স্মরণকালের সবচেয়ে ভয়াবহ আক্রমণ করে বসে— যা শুধু ইসরাইলি নিরাপত্তার দুর্বলতাই প্রকাশ করেনি; বরং সবার সামনে এই সত্যও স্পষ্ট করে দেয় যে, এতো বড় একটি অর্থনৈতিক প্রকল্প ইসরাইলের মতো একটি সংঘাতময় দেশের মধ্য দিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ, যে কোনো মুহূর্তে তা হা.মাসের আক্রমণের মুখে পড়তে পারে। এমনকি তা হা.মাসের অর্থনৈতিক উৎস হিসেবে কাজ করতে পারে।

তাছাড়া ৭ই অক্টোবরের হামলার পরবর্তী সময়ে ইসরাইল কর্তৃক হাজার হাজার বেসামরিক লোককে হত্যা ও নির্বিচারে বাড়ি-ঘর, রাস্তা-ঘাট ও হাসপাতালের মতো গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ধ্বংস করার অপরাধ— সৌদি-ইসরাইল সম্পর্ককে জটিল করে তুলেছে। ফলে এই মুহূর্তে ইসরাইলের সাথে সৌদি আরবের সম্পর্কোন্নয়নের মতো আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেওয়ার সব পথ বন্ধ হয়ে যায়। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, হা.মাসের ৭ তারিখের আক্রমণ ভারত-মধ্যপ্রাচ্য-ইউরোপ অর্থনৈতিক করিডোর প্রকল্পকে জন্মের পূর্বেই মৃত্যুমুখে পতিত করে। (দেখুন, The Diplomat, ১৭ই অক্টোরব, ২০২৩)।

এভাবে হা.মাসের ৭ই অক্টোবরের ইসরাইল আক্রমণ মুহূর্তে ভারত ও মিত্রদের দীর্ঘদিনের কর্মযজ্ঞ ও পরিকল্পনা সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মুখে ফেলে দেয়। পাশাপাশি ভারতকে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ থেকে বঞ্চিত করে। এমন জটিল পরিস্থিতিতে ভারত সরকার ও ভারতীয় হিন্দুদের ইসরাইলে পক্ষে দাঁড়ানোই স্বাভাবিক এবং যে হা.মাস মুভমেন্ট তাদের এতো বড় অর্থনৈতিক ও ভূ-রাজনৈতিক ক্ষতির জন্য সরাসরি দায়ী— তাদের বিরুদ্ধে উদ্ভট সব গুজব ছড়ানো অস্বাভাবিক কিছু নয়। এহেন পরিস্থিতিতে কোনো কোনো উগ্র ভারতীয়ের ইসরাইলে গিয়ে সরাসরি হা.মাসের প্রতিরোধ যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার ঘোষণাও অবাক হওয়ার মতো বিষয় নয়।