সাম্য-মানবিক মর্যাদা তথা স্বাধীনতা ও গনতন্ত্রের হম্বিতম্বি, গালগপ্পোঃ শাহাবাগী লাশতন্ত্রের খতিয়ান

By Tareq-ul Huda

 

“The idea according to which life in a democracy is fundamentally peaceful, policed and violence free (including the form of war and devastation) does not stand up to the slightest scrutiny.”

- Achille Mbembe, Necropolitics

❝রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার প্রশ্নই আসেনা! রাষ্ট্রপতি ক্ষমা করার কে! আমি কেন রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাইবো! বরং, রাষ্ট্রপতির উচিত আমার কাছে ক্ষমা চাওয়া।❞

-  শহীদ মীর কাশেম আলী

(৩১ জানুয়ারি, ১৯৫২ - ৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৬)

১।

২০১৩ সালে শাপলায় অবস্থানকালে আমার অভিজ্ঞতা থেকে যদি বলি, তাহলে একটা লাশের কথা ভূলবো না কখনো। জানি না সেই লাশটা কখন জ্যান্ত ছিল। একদম শেষ সময়ে কি তিনি লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ বলতে পেরেছিলেন? অথবা ঠিক কোন মানুষটার মুখ তার মানসপটে ভেসে উঠেছিল জীবন মৃত্যুর সেই সন্ধিক্ষণে? পেয়ারী শিশু সন্তানের, অথবা স্ত্রীর, নাকি যার পায়ের তলায় জান্নাত, সেই মহীয়সীর? আবার একদম কারো কথা মনে নাও আসতে পারে শাহাদাতের সেই মাহেন্দ্রক্ষনে। হতে পারে রাষ্ট্রীয় আত্মার যেই ক্ষত সাড়ানোর নিয়্যতে এত বড় অভিযানে সামিল হয়েছেন, সেই নিয়্যতের প্রতিধ্বনিই শুনতে পাচ্ছিলেন হয়তো। এমনকি মহীয়সী আম্মার পায়ের তলার জান্নাত মূর্ত হবার খবর উনার জান কবজের সময়ে যেই অশরীরি সত্ত্বা দিয়েছিলেন, তাঁকেই দেখে থাকবেন হয়তো। কিন্তু আমরা এসব কোন কিছুই ইন্দ্রিয়তার ভিতর আর ধরতে পারবো না। তবে ৫ই মে কালো রাতে ঢাকার প্রাণকেন্দ্র মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতে ইসলামের সভার মঞ্চে সেই সাদা কাফনে ঢাকা শান্ত লাশটা শুয়ে শুয়ে কি ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছিলো?

আমার কেন যেন মনে হচ্ছিলো যে একটা জীবিত লোক এমনি একটা সাদা চাদড় মুড়ে চিৎ হয়ে বিশ্রাম নিচ্ছেন ভাতঘুম দুপুরে। আর একটু পরেই হুট করে উঠে পড়বেন। আরো ভাবছিলাম কিভাবে এমন হলো! কে যেন বলেছিলেন, কাফন এক আজীব চীজ বটে! যে বিক্রি করে সে তো বটেই আবার যে কিনে সেও ব্যবহার করে না। আর যে ব্যবহার করে সে জানেও না যে সে কাফন ব্যবহার করছে। তবে সেই আলেমের লাশ মোড়ানো সাদা কাফনটা যেন থেকে থেকে ব্যাকুল হয়ে আমার সাথে কথা বলতে চাইছিলো। আমিও থেকে থেকে তাকাচ্ছিলাম কাফনের দিকে। কাফনটা কি লাশের নিঃশ্বাসে একটু একটু ফুলে উঠছিলো? সেই লাশের রুহের রোশনী যেন আমার ভিতরে প্রবেশ করেছিলো। শুধু আমার না। আরো অনেকেরই, যারা সেইখানে উপস্থিত ছিলেন অথবা অনুপস্থিত।

হাজির লাশের অধিকারী যিনি- বিগত তিনি। আর আমরা স্বপ্রানেই হাজির। যেই অর্থে কোন নুড়ি বা পাথর অথবা হাতের নাগালে পরে থাকা কোন বস্তু প্রানহীন, সেভাবে লাশ তো নির্জীব না। বস্তুরাজি তো কখনোই জীবিত ছিল না, কিন্তু লাশ তো লাশ হবার ঠিক আগেও ছিল প্রানবন্ত । জর্মান দর্শনগুরু মার্টিন হেইদগর তাঁর “বিয়িং এন্ড টাইমে” অস্তিত্ত্বের অন্বেষনে ছড়িয়ে দিয়েছেন মরনের এই ভাবের আলোপ। উনি দেখালেন নিস্প্রান লাশের হাজিরা কিভাবে জিন্দা মরদদেরও ঠেলে দেয় অস্তিত্বের অতলান্তে। লাশ যখন জীবিত ছিল, জ্যান্ত তরতাজা ছিল তখন একেবারে প্রথমে সে মহাকাশে কোন ব্ল্যাকহোলে জন্মায় নাই, মায়ের গর্ভেই ফুলের মতোন ফুটতে থাকে। এরপরে সেই গর্ভ ছেদ করেই তাকে ছুঁতে হয় মাটি, নিতে হয় মাটির স্বোদা গন্ধ। যেই মানব সত্ত্বাকে (Da-sein) ছুঁড়ে দেয়া হয়েছিলো, তার আশেপাশে আরো অনেক অস্তিত্ত্বময় সত্ত্বা এবং বস্তু ও জিনিসপত্র। আবার এই জগতে তার আবির্ভাব শর্তহীন অসীম অনিত্য নয়। বরং জগত জীবনের অন্য সব কিছুর মতোই নিত্য, সীমাবদ্ধ, কিন্তু সম্পর্কিত। আপন এই সত্ত্বা আবার নিজের চাইতে এগুয়ান। সে এখনো যা না, যা কিছু এখনো তার জীবনে হয়ে উঠে নাই, সেই ভবিষ্যতের সম্ভাবনাকেও সে তাড়নায় কামনায় বাস্তব রুপ লাভের আগেই অনুমান করে, কল্পনা করে। করতে করতে সে অস্থির হয়, অথবা আপ্লুত হয়। ভীত বা সন্ত্রস্ত হওয়াও বিচিত্র নয়। এখনো বাস্তবে নাই, কিন্তু সম্ভাবনায় আছে- এমন অনেক কিছুর ভিতরে কোন কোন সম্ভাবনা মূর্ত হয়ে উঠে ভবিষ্যত জীবনে, আর কিছু অধরাই থেকে যায়। অধরা থাকলেও অস্তিত্ত্বের স্বধর্মই হলো প্রতিনিয়ত সম্ভাবনার নৈরাজ্যময় ভবিষ্যতে নিজেকে প্রক্ষেপ করা। তারপরেও এত সম্ভাবনা বা অসম্ভাবনা, পাওয়া না পাওয়ার হিসাব মিলানো সহজ হত, যদি জীবনটাকে শুরু থেকে শেষ অবদি একটা গোটা আস্ত বেদানার মতো আমরা হাতের নাগালে পেতাম। অথচ শেষ বিন্দুতে তার ঠিক আগেই জীবনের মতো মরনও হাজির। তবে তো মৃত্যুও শেষ হিসাবে জীবনের সকল সম্ভাবনা ও না-সম্ভাবনার মোহনা, পরিনত বিন্দু। এখন যেহেতু নিজের মৃত্যুর স্বাদ গ্রহনের পরে ঢেকুর তোলা সম্ভব না, সেহেতু অপরের মরন দর্শনের অভিজ্ঞতাই হয়তোবা দিতে পারে অর্থময় ইঙ্গিত। কিন্তু সেই মরন তো অপরের, নিজের না। আবার অন্যান বস্তু বা জিনিসের মতো না মানুষের অস্তিত্ব। কোন ফুল বা ফল যেমন পরিপূর্নতা পাওয়ার পরেই মরে পচে যায়, মানুষের মৃত্যু তো তেমন না। মানুষ অবশ্যই মরনের ভিতর দিয়ে শেষ হয়, কিন্তু সকল মানুষ তো আর মরনের ভিতর দিয়ে আপন জীবনের পরিপূর্নতা নাও পেতে পারে। সেই সময়ে তার জীবনের সম্ভাবনাগুলি বাস্তব রুপ নাও লাভ করতে পারে। অস্তিত্বময় মানুষের মৃত্যু ভাব তাই না অন্যান্য জীব বা প্রানহীন বস্তুর মতো, না নিছক সামাজিক অপর বা অন্য কোন মানুষের মৃত্যুর মতো, যার জীবন শুধু অস্তিত্ত্বময়তার প্রশ্নহীন প্রানী বা বস্তুর মতো। অস্তিত্বময় মানুষ হিসাবে নিজের মৃত্যু নিয়ে তবে আমরা হয়তো শুধু এইটুকুই বলতে পারি যে, জীবনের যাত্রা হলো মৃত্যুর পথে যাত্রা[U1] [U2] [U3] । মৃত্যুর স্বাদের বর্ননা বা বয়ান তৈরি যেহেতু অসম্ভব, সেহেতু জন্মানোর পরেই ক্রমাগত মৃত্যুর দিকে ঝুঁকে পড়া জীবনই তার উপজীব্য। জীবনের কথা তাই মৃত্যুরই প্রস্তুতি। [i]                   

তবে হেইদগরের সুযোগ্য ছাত্র হিসাবে না হোক, একজন অযোগ্য গুনাহগার মুসলিম হিসাবে অস্তিত্ত্বের মর্মজিজ্ঞাষাকে (Ontology) এড়ানোর আর কোন উপায় থাকে না শাপলার মঞ্চের সেই লাশের জাহিরি অবয়বের সামনে। যিনি মৃত্যু বরন করলেন তার জীবন বা মরন যাত্রায় যদি আরেক জনও শরিক হিসাবে উপস্থিত থাকে, তবে উপরে বর্নিত হেইদগরের জীবন বা মরন জিজ্ঞাষাকে আরেকটু প্রসারিত করে দেখা যেতে পারে। সকল অপরের মৃত্যু আমার জীবন জিজ্ঞাষার জিগস পাজল মিলাতে না পারলেও, হয়তো কোন কোন অপরের মৃত্যু পারে। যদি সেই অপরের অস্তিত্ব্বময়তার শর্ত, জটিলতা কারো আপন জীবনের জিগস পাজলের তালা খোলার চাবি হয়, যদি তার আর আমার মরন যাত্রার কাফেলা এক হয়, তবে তার মৃত্যুকে আমার জীবনের পরিপূর্নতার হিসাবের বাইরে রাখা অসম্ভব হয়ে উঠে। তাই সেই শহীদের মরন আপন মরনের রুপকল্পে পরিনত হয়। খাঁটি অস্তিত্বময়তার (Authentic Dasein) অংশ হিসাবেই তখন তা প্রতিভাত হয়ে উঠে। সেই শহীদ যেন সতীর্থ গাজীর জবানে কথা কয়ে উঠেন। কাজেই শাপলা মঞ্চের সেই লাশ যে কোন যেনতেন লাশ না। জীবনের যত্রতত্র আমরা যে সাধারন মৃত্যু দর্শন করি, এই মরন কে তার সাথে মিলানো যায় না।

শাপলায় ফুটে থাকা সেই লাশেরও আত্মপরিচয় আছে। আর তা হলো “মুসলিম”। যার কর্তাসত্ত্বার (Subjectivity) উৎসে থাকে অস্তিত্ত্বের মর্মজিজ্ঞাষা (Ontology)। এই মর্মের বিনিসূতাতেই বাঁধা থাকে মুসলিমদের জীবন থেকে মরন। সাচ্চা মুসলিম তার যাপিত জীবনকে অন্য সব কিছু থেকে আলাদা করে স্বত্তা বিচ্ছিন্ন জীবন (Inauthentic Dasein) বেছে নিতে চায় না। ঠিক এই কারনেই একজন মুসলিমের অস্তিত্ত্বময়তার রোশনী যদি তার কর্তা সত্তায় সঠিক ভাবে প্রতিফলিত হয়, তবে ঐতিহাসিক কর্তাসত্ত্বা (Subjective self)  হিসাবে তার যাপনে ও রাজনৈতিকতায় সেক্যুলারাইজেশন ( ধর্মীয়তাকে বিচ্ছিন্নকরন) এবং ডিথিওলাইজেশন (নিধর্মীকরন) অসম্ভব হয়ে উঠে। সাচ্চা মুসলমানের এই নিয়্যত সমাজে তার অপর একাংশের কাছে অসহনীয় মনে হয়। সাচ্চা মুসলমানের জীবন আর প্রানকে তখন তারা নিজের জীবন আর প্রানের অস্তিত্ত্বের জন্যে হুমকি মনে করতে থাকে। দ্বন্দ্ব সংঘাত তখন অনিবার্য হয়ে উঠে।

২।

এই পর্যায়ে আমরা দেখব যেই দুনিয়া আমাদের সামনে হাজির, সেই দুনিয়ার ঐতিহাসিক বর্তমান হালত। এই দুনিয়া উপনিবেশ উত্তর বলে গুজব রটিয়েছেন আধুনিক সেক্যুলারবাদীরা। প্রকৃত প্রস্তাবে উপনিবেশ কাল গত হলেও উপনিবেশিকতা যে বহাল, তাতে কোনই সন্দেহের অবকাশ নাই। ভারত উপমহাদেশ থেকে উপনিবেশীরা স্বশরীরে বিদায় হলেও, রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ব্যবস্থার ভিতর দিয়ে মূল প্রভাবক হিসাবে উপনিবেশী কাঠামো ও মূল্যবোধ প্রাধান্য বিস্তার করতে থাকে। সে সময়ে যে রাস্ট্রগুলি প্রতিষ্ঠা পায়, উপনিবেশজাত আধুনিক মূল্যবোধের উপরেই প্রতিষ্ঠা পায়। আধুনিক ইন্ডিয়া সার্বিক এবং পরিপূর্নভাবেই উপনিবেশী ইউরোপীয় মুল্যবোধ এবং মতাদর্শিক ভিত্তির উপরে গড়ে উঠে। কিন্তু পাকিস্তানের ক্ষেত্রে আমরা পরিস্কার ভাবে ব্যতিক্রম দেখতে পাই। এর মূল কারন ইসলাম এবং মুসলিম জনগন।

মুসলিম জনগনের রাজনৈতিকতা ধারন করতে পারে এমন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ ভূমির ভিত্তিতে রাজনৈতিক স্বত্তা নির্মানের ভিতর দিয়েই ভারতের পূর্বে ও পশ্চিমে পাকিস্তান তৈরি হয়। তবে এখানে অনেকগুলি চ্যালেঞ্জ ছিল। আধুনিক রাষ্ট্র এবং নাগরিকের যে সম্পর্ক বিদ্যমান একদিকে তাকে ধারন করতে হবে, আবার অন্যদিকে এই সম্পর্ক যেন তা মুসলিম অস্তিত্ত্বময়তার (Islamic/Muslim ontology) ভিতর বিরোধ না তৈরি করতে পারে সেই ব্যবস্থা রাখা। এই সমস্যা কিন্তু ১৯৪৭ এর ভারতে ছিল না। এর কারন ইউরোপে যেমন প্রটেস্ট্যান্ট এবং ক্যাথলিক খ্রিস্টান অস্তিত্ত্বময়তা (Christian ontology) আধুনিকতার ভিতর বেশ ভালো ভাবেই খাপ খেয়ে যায়, আধুনিক ভারতেও তেমন হিন্দু অস্তিত্বময়তা (Hindu ontology) আধুনিক রিপাবলিক মতাদর্শিক কাঠামোতে মিলে যেতে পেরেছিল। ইউরোপের মতো ভারতেও হিন্দু ধর্ম এবং তার মূলসুত্রগুলি মানুষকেন্দ্রিক (Anthropomorphic)। খ্রিস্টান ধর্ম যেভাবে মানুষকেই ইশ্বররুপে দেখতে শুরু করেছিল, হিন্দু ধর্মের ইতিহাসে তেমনটা ঘটেছিলো তার অনেক অনেক আগে। প্রাচীন হিন্দু মতে, পরম স্রস্টা নিজে নিজেকে বিভাজিত করে একদিকে সৃষ্টি আরেকদিকে স্রস্টা হিসাবে অস্তিত্ত্বময় হয়ে উঠে। আর এটাই সৃস্টির প্রক্রিয়া। কাজেই স্রস্টা, সৃস্টি এবং সৃস্টির প্রক্রিয়া এক। এটাই হিন্দু সৃস্টিতত্ত্ব। কাজেই দেখা যাচ্ছে, এই দুই ধর্মের অনুসারীরা আধুনিকতার অনেক আগে থেকেই মানবকেন্দ্রিক পথের পথিক। আবার নাস্তিক বা ধর্মহীন মানুষরা তো স্বাভাবিক স্বতস্ফূর্তভাবেই মানবকেন্দ্রিক। আধুনিকতাকে তাই পশ্চিম এবং ভারতীয় ধার্মিক জনগন নাস্তিক এবং ধর্মীয়ভাবে সংশয়ীরা একসাথে খুব সহজেই গ্রহন করতে পেরেছিলো। অপরদিকে বৈশ্বিক মুসলিম সমাজে ঠিক এই জায়গা এসে আমরা ঠিক উলটা চিত্র দেখি। মুসলিম সমাজ খিলাফত কালে শারিয়াভিত্তিক হওয়ায়, তার ভিতর মুসলিমদের আইনগত-রাজনৈতিক-রাস্ট্রীয় থেকে ব্যক্তিগত কোন পর্যায়েই কোন রকম বিচ্ছিন্নতা দেখা দেয় নাই। খিলাফত শাসনের ভিতর কখনই খলিফা এবং রাজা-বাদশাহরা রাষ্ট্রীয় নীতির জায়গায় নিজেকে আল্লাহর চাইতে অধিক ক্ষমতার অধিকারী দাবি করেন নাই, করার প্রয়োজনও হয় নাই। মোটাদাগে তারা নিজেকে ঐশ্বরিক সত্ত্বার  প্রতিনিধি বলতেন। কিন্তু ঠিক এই সার্বভৌমত্বের অধিকারী কর্তাস্বত্তার জায়গাতেই আধুনিক সেক্যুলার রাষ্ট্র বড় রকমের সমস্যা তৈরি করে ফেলে, যা মুসলিম অস্তিত্বের জন্যে হূমকী হয়ে দাঁড়ায়। কারন আধুনিক রাষ্ট্র সর্বময় ক্ষমতার সার্বভৌমত্বের একচেটিয়া ক্ষমতা দাবী করেন আনুষ্ঠানিক ভাবে। রাস্ট্রের এমন দাবী শতভাগ যথার্থ শুধু তাদের কাছেই, যারা সম্পূর্নভাবে মানবকেন্দ্রিক (Anthropomorphic) জীবন ব্যবস্থাকে গ্রহন করতে পারেন। মানবকেন্দ্রিক আধুনিকতার উন্মেষের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সামাজিক গোষ্ঠীগুলির ভিতর আধুনিকতার অন্যান্য উপাদানগুলির কার্যকরী প্রভাব দেখা যায়। যেসবের ভিতর বিজ্ঞানমন্সকতা, যুক্তি-বুদ্ধি, ঐতিহাসিক প্রগতি, ঐতিহ্যের প্রতি অনীহা, ধর্মের প্রতি প্রতিক্রিয়াশীলতা, ধর্মীয় আত্ম-পরিচয়কে অপরিনত-অপর্যাপ্ত এবং কাল্পনিক ভাবা, অতিমাত্রায় অভিজ্ঞতানির্ভর জ্ঞানের প্রতি নির্ভরশীলতা ইত্যাদি বিষয়গুলি খুবই প্রকট।        

বলাই বাহুল্য যে, মুসলিম অস্তিত্ত্বময়তার (Ontology) উদয়বিন্দুই হলো ঈমান, যার ভিত্তি তাওহীদ। যে নিজেকে মুসলিম বলে, তাকে সবকিছু বাদ দিলেও এই জায়গায় কোনই দ্বন্দ্বের সুযোগ নাই। হেইদগরের মূল চিন্তার সাপেক্ষেও বলা যায়, মুসলমানের খাঁটি স্বত্তার (Authentic Dasein) মর্মই হলো তাওহীদ ভিত্তিক ঈমান, যা মানবকেন্দ্রিক না। আবার অপরদিকে একজন হিন্দু অথবা খ্রিস্টান বা নাস্তিক কিংবা সংশয়বাদীর খাঁটি অস্তিত্ত্বময়তার কেন্দ্র বিন্দুই হলো মানবকেন্দ্রিকতা। আধুনিক ব্যবস্থার গোঁড়াই হলো এই মানবকেন্দ্রিকতা, যা ধর্মীয় বা অধর্মীয়- দুই হতে পারে। এর পাশাপাশি রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার দিক থেকে দেখলে আমরা বুঝতে পারবো যে, পশ্চিমে উপনিবেশকালে তাদের নিজের ভূ-খন্ডে বসবাসরত জনগন বিশাল মৌলিক পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যাচ্ছিল। ইউরোপে শিল্প বিপ্লব, রাজতন্ত্রের অন্তর্গত প্রজাস্বত্ত্বার বিপরীতে নাগরিক স্বত্ত্বার উন্মেষ ও বিকাশ এবং এই সাপেক্ষে রাজনৈতিক অধিকারেরও বিকাশ, সামন্ততান্ত্রিক ভূমি ব্যবস্থা থেকে ব্যক্তিগত সম্পত্তির দিকে উত্তরন, চার্চের ক্ষমতার সঙ্কোচন, বুর্জোয়া ক্ষমতার উদয়, কৃষি থেকে শ্রমভিত্তিক শিল্প কারখানায় কাজ শুরু, শিল্প-সাহিত্য-নান্দনিক জগতে রেনেঁসা ও আধুনিক মূল্যবোধ ও রুচির উন্মেষ, মৌলিক ভৌত এবং অভিজ্ঞতা-ভিত্তিক বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির ব্যাপক প্রসার এবং সামরিক শিল্পে এর প্রয়োগ, প্রেস ও ছাপাখানার প্রসার - ইত্যাদি এবং আরো পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে যেই ধরনের ক্ষমতা তৈরি হয়, তাতে ব্যক্তিগত (প্রাইভেট) এবং সামাজিক-নাগরিক (পাবলিক) এই দুই পরিসরে দুনিয়া ভাগ হতে থাকে। একথা স্পস্ট যে, এই পরিবর্তনের ভিতর দিয়ে শক্তিশালী মানব কেন্দ্রিক চিন্তা চেতনাকে সামনে নিয়ে আসা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। আবার এই মানবকেন্দ্রিকতা পজিটিভিস্ট আইন এবং সংবিধানের মূল উৎস, যার ফসলই হলো সাম্য-মানবিক মর্যাদা ইত্যাদি বুনিয়াদী সেক্যুলার মূল্যবোধ।

সামন্ততন্ত্র ও চার্চের মিত্রতা ভেঙ্গে দিয়ে ব্যক্তিতান্ত্রিক আধুনিক নাগরিক ভিত্তিক ক্ষমতাকে প্রতিষ্ঠা করার এই সংগ্রামে আস্তিক খ্রিস্টান, নাস্তিক বা সংশয়বাদী যারাই সামিল হয়েছেন, তারা মোটাদাগে মানবকেন্দ্রিক রাজনৈতিক ক্ষমতার পক্ষেই ছিলেন। মতাদর্শিকভাবে এখানে আমাদের লক্ষ্য রাখা খুব প্রয়োজন যে, প্রাক আধুনিক কাল থেকেই মানুষের আত্ম-পরিচয়ের ধর্মীয় দিক সংকুচিত হতে শুরু করে। আম এবং সার্বজনিন (ইউনিভার্সাল) ভাবের দিক থেকে এমন আত্মপরিচয় আস্তে আস্তে তৈরি হয়, যার ভিতর উপরে বর্নিত প্রাইভেট এবং পাবলিক বিভক্তি বজায় রাখা যায়। সেই সার্বজনীন সত্ত্বাই হলো নাগরিকতা। নাগরিকের ধর্ম থাকলে থাকতেও পারে, আবার নাও পারে। যদি ধর্ম থাকে, তবে তা নাগরিকের ব্যক্তিগত পরিসরেই শুধু সীমাবদ্ধ থাকবে। আবার ব্যক্তি নাগরিক রাজনৈতিক ক্ষমতা চর্চা করবে যেই জগতে, সেটা উক্ত নাগরিকের পাবলিক পরিসর। নাগরিকের ধর্ম পাবলিক পরিসরের বিষয় না। নাগরিকের ধর্মীয় পরিচয়ের পার্থক্য পাবলিক আ গন পরিসরে আসতে পারবে না। একইভাবে পাবলিক পরিসর যেই নীতি-নিয়মের অধীন তাতে ধর্মের কোন বিধি নিষেধ থাকতে পারবে না। যিনি যেই রাস্ট্রের নাগরিক, সেই রাষ্ট্র চলবে নাগরিক সমতার ভিত্তিতে। এখানে সকল নাগরিক সমান। হিন্দু-বৈদ্ধ-নাস্তিক-সংশয়বাদী ইত্যাদি ব্যক্তিগত পরিচয় যার যাই হোক না কেন, সরকারের নীতিমালায় তাদের সবার পরিচয় এক এবং সমান। আইনগত অধিকারের দিক থেকেও তাই। একজন আলেম, একজন সমকামী নৃত্যশিল্পী- এরা উভয়েই সমান। এরই প্রতিফলন হলো সংবিধানে উল্লেখিত ‘সাম্য’ (Equality)। অর্থাৎ সেক্যুলার আদর্শ সাম্যের ভিতরে নাগরিকের বিশেষ আত্ম-পরিচয়ের বিলর ঘটে।

আগে যা বলা হয়েছে, এই বিশাল পরিবর্তনে খ্রিস্টান সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজ ও দেশ সমূহে খুব বড় ভোগান্তি পোহাতে হয় নাই। চার্চও এভাবে সংকুচিত হয়ে আসাকে মেনে নিয়েছে। নাস্তিক-সংশয়বাদীরা তো বটেই, পাশাপাশি একজন বিশ্বাসী খ্রিস্টানও মানবকেন্দ্রিকতার ভিতরেই নিজের আইনী অধিকারকে সীমিত রাখাকে বেছে নিয়েছিল। খ্রিস্টানদের কাছে স্বয়ং ইশ্বরেরই প্রকাশ যদি জিসাস হন, তবে এই মেনে নেওয়ার ভিতরে বড় কোন ভারসাম্যহীনতা তৈরি হয় না। বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ তালাল আসাদও মনে করেন, আধুনিক সেক্যুলারিজমের অন্যতম ভিত্তি নাগরিক সাম্যের ধারনার সাথে খ্রীস্টানদের আত্তীকরণ প্রক্রিয়া স্বতঃস্ফূর্ত ছিল। এতে তাদের মূল আকিদা ও ঈমানগত কোনই অসংগতি তৈরি হয় না। এদিকে ভারতে ৪৭ সালের পরে বিউপনিবেশীকরন প্রক্রিয়া ছাড়াই পশ্চিমা পদ্ধতির সংবিধান প্রনয়ন করা হয়। এতে ভারতীয় অমুসলিমরাও মানবকেন্দ্রিক ধর্ম মতের (স্রস্টা-সৃস্টি-সৃস্টির প্রক্রিয়া এক) কারনে খুব সহজে সেক্যুলার মতাদর্শ গ্রহন করে নেয়। কিন্তু মুসলিমদের ক্ষেত্রে এমনটা একেবারেই হয় নাই। কারন তাওহীদ ও ঈমান তথা ইসলামী মৌলিকতা সংকুচিত না হয়ে প্রতিফলিত হতে পারে এমন রাজনৈতিক ব্যবস্থা পশ্চিমা ধারার আধুনিকতার ভিতরে ৪৭ পর্যন্ত কল্পনা করার বাস্তব কোন কারনই পরিলক্ষিত হয় নাই।

আধুনিক সেক্যুলার রাস্ট্রের উসূলি ধারনা ‘সাম্য’ কে মেটাফিজিক্স অব উইনিভার্সালিজম বা সামান্যতার বিমূর্ত কল্পনা বলা হলে অত্যুক্তি হবে না। কেন সাম্যভিত্তিক রাস্ট্রে এই সামান্যতা বিমূর্ত কাল্পনিক? কারন সামান্যতা-আম-ইউনিভার্সাল এসব ধারনার মূল অনুমানই হলো আমাদের আত্ম-পরিচয় নিছক “মানুষ”। এইদিক থেকে আমরা কি হিন্দু, নাকি বৌদ্ধ, নাকি মুসলিম – এসব আত্ম-পরিচয় প্রধান না। ধর্মভিত্তিক আত্ম-পরিচয় মাত্রই সীমাবদ্ধ। ধর্মভিত্তিক আত্মপরিচয়ের নিগড়ে মানবতাই বরং সংকুচিত হয়ে পরে। আধুনিক সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্রে তাই ধর্মীয়তা নিছকই বিশেষ বা পার্টিকুলার বিষয় যা আগ্রাহ্য করার মতো অপ্রাসঙ্গিক। সামাজিক প্রগতির দিক থেকেও ধর্মভিত্তিক আত্ম-পরিচয় প্রাচীন, পুরানো এবং নতুন আধুনিক যুগের দিক থেকে অকেজো। আধুনিক সময়ের দাবী মিটাতে অক্ষম। যেহেতু আধুনিক রাজনীতি পাবলিক বা গনপরিসর ভিত্তিক, সেখানে মানুষ হিসাবেই আমাদের ক্ষমতা চর্চা করতে হবে। বিশেষ কোন ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিকতাকে আনা যাবে না। তাতে গনপরিসরের বৈশিষ্ট্য ক্ষুন্ন হবে। কারন বিশেষ ধর্ম শুধু সেই ধর্মের অনুসারীদের রাজনৈতিক অধিকারই নিশ্চিত করতে পারে এবং ধর্ম সেখানে ব্যর্থ। অপরদিকে, ইসলামী জায়গা থেকে কোন মুসলিম নিজেকে বিভক্ত করে ব্যক্তিগত পরিসর ও গনপরিসরে সেক্যুলার “মানুষ” হয়ে জীবন যাপন করতেও পারবে না। এর অবশ্যম্ভাবী ফলাফল হলো মুসলিম আত্মস্বত্তা এবং কর্তাস্বত্ত্বাকে পাবলিক বা গনপরিসর থেকে নির্বাসিত করার ভিতর দিয়ে সেক্যুলার ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করা। অধ্যাপক সালমান সায়্যিদ বিষয়টিকে আরো প্রসারিত করেন, ‘ The core of the argument is that Secularism deligitimates the claims of the religious authorities to control the production of knowledge the conditions for the rejection of ontological claims found in sacred narratives in favour of a scientifically oriented ontology.’[ii]  

ঠিক এইখানেই উপমহাদেশের মুসলিম নেতৃত্ব নতুন মৌলিক রাজনৈতিক মডেল প্রস্তাব করেন, যা কিনা পাকিস্তান। যা অবশ্যই আধুনিক কিন্তু আবার সেক্যুলার না। কারন পাকিস্তান এমনি এক রকমের আধুনিক রাষ্ট্র যা মুসলিম আত্মস্বত্ত্বাকে স্বীকার করে নিয়েছিল। প্রথমে নিছক মুসলিম সংখ্যা গরিষ্ঠ রাষ্ট্র হিসাবে আত্ম প্রকাশ করলেও, আস্তে আস্তে তা আলেম উলামাদের ঐকান্তিক প্রচেস্টায় সাংবিধানিকভাবে আধুনিক মূল্যবোধের পাশাপাশি ইসলামী চেতনাকেও গ্রহন করে। সংবিধানে প্রথমেই হাকিমিয়ার ঘোষনা দেওয়া হয়। রাষ্ট্র যেন ইসলাম ধর্মীয় বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং আইনগত দিক থেকে যেন ইসলামী আইনের সাথে আধুনিক আইনের দ্বন্দ্ব তৈরি না হয়, তার জন্য রাস্ট্রীয় ভাবে শারিয়া আইন বরাবর আধুনিক সংবিধানকে উপযুক্ত করা হয়। পাকিস্তানের লম্বা সংবিধান সভায় গৃহীত এই পরিবর্তনে পাকিস্তানের আলেমদের সাথে বাংলাদেশের আলেমরাও অংশ নিয়েছিলেন। ইনাদের ভিতরে একজন উল্লেখযোগ্য আলেম হলেন, মাওলানা সামসুল আলম ফরিদপুরী (রহঃ)। ইসলামী ধারার রাজনীতি করার অবাধ সুযোগ তৈরি হয়, সেক্যুলার আধুনিক ধারার পাশাপাশি। এর বড় প্রমান, ন্যাপ, আওয়ামী লীগ, মুসলিম লীগ, কৃষক-প্রজা পার্টি, ইত্যাদি আধুনিক রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি আলেম-ওলামা ভিত্তিক নেজামে ইসলামও প্রবল প্রতাপে রাজনৈতিক কর্মকান্ড চালিয়ে যেতে পেরেছিল। যুক্তফ্রন্ট তৈরি করে নির্বাচন জিতে সরকারও প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। সংসদে তাদের নির্বাচিত সদস্য ছিলেন। আধুনিক-ঐতিহ্যবাহী সহ আরো নানা ধারার মুসলিমরা একত্রিত হতে পেরেছিলেন এক উদ্দেশ্যে।

তবে একথাও বুঝা খুব প্রয়োজন যে, ১৯৪৭ এ প্রখ্যাত ইসলামী ব্যক্তিত্ব শাইখ হোসেন আহমেদ মাদানী (রঃ) ধারার মুসলিমরাও নয়া আধুনিক সেক্যুলার রাষ্ট্র ইন্ডিয়ার সংবিধান গ্রহন করেন। কিন্তু তাদের এই গ্রহন করার সাথে হিন্দুদের সেক্যুলার হওয়ার সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিল। হোসেন আহমেদ মাদানী (রঃ) হুজুর রচিত “মুত্তাহিদা কওমিয়াতে” স্পস্ট যে, উনি পশ্চিমা রাজনৈতিক চিন্তা আকারে আধুনিক প্রজাতন্ত্রের উসুলি বা বুনিয়াদী ধারনাগুলি বুঝতে না পেরে, সেই রাজনৈতিক কাঠামোকে মোগল সালতানাতের আলোকে ভেবেছিলেন। অর্থাৎ উনার কাছে মোগল সালতানাতের প্রজা এবং আধুনিক ইন্ডিয়ার নাগরিক এক হয়ে ধরা পড়েছিল। কাজেই উনি এই কল্পিত হিন্দুস্তানের ভেঙ্গে যাওয়াকে নিতে পারেন নাই। “প্রজা” এবং “নাগরিক” ধারনার ভিতর গুনগত এবং পরিমাণগত ভেদও ধরতে ভূল করেছিলেন। নিজে যে একজন প্রজা থেকে নাগরিকে পরিনত হয়েছেন, সেই পরিবর্তন নজরে পড়ে নাই। অথচ একই দেওবন্দের মহাত্মা হাকিমুল উম্মাহ মাওলানা আশরাফ আলী থানভী (রহঃ) এবং সাব্বির আহমেদ উসমানী (রহঃ) এবং তাঁদের সতীর্থরা এই ভূল করেন নাই।                  

৩।

অপরদিকে পশ্চিমা মতাদর্শকে নির্বিচারে গ্রহন করা, নিজ সমাজের দাবী অগ্রাহ্য করা, আধুনিকতা ও আলোকায়ন (এনলাইটেন্মেন্ট) এবং সেক্যুলারিজমকে কে আদর্শ হিসাবে ধারন করে ধর্মীয়তা মাত্রই সাম্প্রদায়িক সংঘাতের কারন হিসাবে ভাবা, ইত্যাদি দিকগুলি ছিল সেক্যুলার প্রগতিশীল বাম এবং বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদী আত্মসত্ত্বার মূল লক্ষণ। সকল মতাদর্শের মতো সেক্যুলার দর্শনেরও নানান ফেরকা আছে। আবার খুব সাধারন বা কমন দিকও আছে। “আওয়ামী মুসলিম লীগ” নাম থেকে “মুসলিম” শব্দ বাদ দিবার ভিতর দিয়ে পাকিস্তানে সেক্যুলার প্রগতিশীলতা তুরস্কভিত্তিক আধুনিক সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ কামালবাদের দিকে ঝুঁকে পড়েছিল। এর মূল দিক ছিল, আনুষ্ঠানিক ভাবে ইসলাম সম্পর্কিত চিহ্ন বা নিশান উঠিয়ে দিবার ভিতর দিয়ে নিজেকে সেক্যুলার প্রমান করা। ভাষা আন্দোলনের পরে এর আরেক রুপ আমরা দেখি যখন উর্দূর বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক ঘৃনা তৈরি করা হয়। ৬৯ এর গণআন্দোলনের সময়ে আওয়ামী লীগ কর্মীদের কেউ কেউ পুরানো ঢাকার উর্দূ সাইনবোর্ড রঙ ঢেলে নস্ট করে পাকিস্তান সরকার এবং রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে তাদের প্রতিবাদ জানাতেন। ইসলামী নিশানা নির্মূলের এই প্রবনতা এমনকি ৭১ ঘুরে বর্তমান পর্যন্ত বিদ্যমান। এভাবে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে ইসলাম ঘৃনার বীজ বপন করা হয়।  পাকিস্তান-উর্দু ভাষার বিরুদ্ধে বিদ্বেষের গোড়ায় যে আদতে ইসলাম ঘৃনা তা বুঝতে মোটেও বেগ পেতে হয় না। এরই পরিক্রমায় যখন ৭১ এর স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়, তখন বাংলাদেশের আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী ইসলামী সমাজ তার বিরোধীতা করে। সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমে দ্বীন মাওলানা হাফেজ্জী হুজুর, মুফতী দ্বীন মুহম্মদ, মাওলানা আজিজুল হক সহ অনেকে পাকিস্তানের নাগরিকদের সশস্ত্র প্রশিক্ষন দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র রক্ষার আহবান জানান।[iii] জামায়াতে ইসলামী সহ আধুনিক ইসলামপন্থীরাও পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই করেন। পাকিস্তানের এই পক্ষ অবলম্বন করা ছিল সেই সময়ে বেশীর ভাগ ঘরানার ইসলামপন্থীদের জন্যে খুবই স্বাভাবিক রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। এমনকি ৭০ এর নির্বাচনেও আমরা দেখি যে চরমোনাই পীর সাহেব মাওলানা সৈয়দ মুহম্মদ ইসহাক (রহঃ) মুরিদদের জামায়াতে ইসলামীর প্রার্থী মাওলানা আব্দুর রাহিম সাহেবকে হক্কানী আলেম উল্লেখ করে ভোট দিতে অনুরোধ করছেন ইসলামী রাষ্ট্র পাকিস্তান রক্ষার্থে।[iv]

১৯৭১ এ ইসলামীরা পাকিস্তানের পক্ষে এভাবে রাজনৈতিক অবস্থান কেন নিতে বাধ্য হয়েছিলেন? বর্তমান সময়ের হকিকত বুঝার জন্যে এ প্রশ্ন খুবই যথার্থ। উত্তর বুঝার জন্যে কল্পনা করা যেতে পারে। ধরা যাক, ভাইয়ে ভাইয়ে কোন স্বার্থের কারনে সংঘাত হলো। এর ফলে এমনও হতে পারে যে, দুই ভাইকে আলাদা হয়ে যেতে হলো। অনেক ক্ষেত্রেই এমন কারনে আলাদা হয়ে যাওয়া উত্তম ফলাফলও বয়ে আনে। কিন্তু কোন ভাই যদি এর পরে আরেক ভাইয়ের প্রতি বিদ্বেষ ও ঘৃনার বশবর্তী হয়ে নিজের পিতার নাম পরিবর্তন করে ফেলে, তাহলে একে ব্যাখ্যা করা যাবে কিভাবে? বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছিলো। পাকিস্তানের সামরিক আমলাতান্ত্রিক বৈষম্য নীতির কারনে যদি বাংলাদেশ নামক নতুন রাষ্ট্র গড়ে উঠে, তবে সেখান থেকে ইসলামকে সমুলে বাদ দিতে হবে কেন? পাকিস্তানী সামরিক আমলাতন্ত্র তো ইসলাম ভিত্তিক ছিল না। তাহলে সামরিক আমলাতন্ত্রকে পরিবর্তন করার অন্তরালে ইসলামী রাজনৈতিকতা তথা বাংলাদেশের মানুষের অবিচ্ছেদ্য রাজনৈতিক চেতনাকেও মুছে ফেলা হবে কেন? কেন এপ্রিল ১৯৭১ এ স্বাধীনতার ঘোষনাপত্রে হাকিমিয়া সাক্ষ্যকে মুছে দিয়ে আলোচিত সেক্যুলারিজমের উসুলি ধারনা সাম্য-মানবিক মর্যাদার কথা শর্তহীন ভাবে উল্লেখিত হবে? কেন নতুন বাংলাদেশের সংবিধান থেকে ইসলাম বাদ দিয়ে শুধু জনগনের সার্বভৌমত্বের কথা থাকবে? কেন নতুন বাংলাদেশে ইসলামী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ থাকবে? এর সদুত্তর আমরা কি যথেস্ট সততার সাথে খুঁজি? যদি খুঁজি তাহলে পরিস্কার বুঝা যাবে এসব ইসলাম খারিজের নীতি প্রকৃত অর্থে কামালবাদী প্রকল্প। যার মূল লক্ষ্য ১৯৪৭ এর অর্জন আধুনিক ইসলামী ব্যবস্থাকে নির্মূল করে শতভাগ আধুনিক সেক্যুলার ইসলামহীন রাজনৈতিক ব্যবস্থা চালু করা। অথচ জনগনের প্রানের ইসলামকে স্বাধীনতার ঘোষনা, নয়া সংবিধানে অটুট রেখেও বাংলাদেশকে রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠা করা যেত। তাতে ১৯৪৭ থেকে বর্তমান পর্যন্ত ঐতিহাসিক রাজনৈতিক চেতনা অবিচ্ছিন্ন থাকত। ইসলামও বহিস্কৃত হত না। ইসলাম বনাম মুক্তিযুদ্ধ এমন বাইনারী তৈরির ভিতর দিয়ে দীর্ঘস্থায়ী রক্তাক্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হত না। কাজেই বর্তমানে রাজনৈতিক পরিসরে ইসলাম যে গুম হয়ে গেছে, তার মূল কারন বাংলাদেশের সেক্যুলারদের তীব্র ইসলামপন্থা বিরোধী কামালতান্ত্রিক সেক্যুলার মনোভাব। ঠিক এইখানেই চূড়ান্ত জুলুমের প্রতীক শাহাবাগের বীজ বপন করা হয়েছিল।

৪।

পশ্চিমের আলোকায়ন পর্ব এবং আধুনিক রাষ্ট্র সম্পর্কে অনেক দিন ধরে প্রচলিত নানা ধরনের অতি ফোলানো ফাঁপানো বয়ান তৈরি আছে। এগুলি যে বয়ান না, নিছক রুপকথা মাত্র – তা বুঝতে আমাদের আরো দেরী করতে হয়েছে। এসব বয়ানের নানা বৈশিস্ট্যের একটা হলো মানুষের মুক্তির আলাপ। এর পূর্বানুমান হলো আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রবর্তনের আগে মানুষ ধর্মীয় সামন্ততান্ত্রিক রাজ্যগুলিতে আবদ্ধ বা অধীন ছিল। আলোকায়ন বা এনলাইটেন্মেন্ট-আধুনিকতা তার এই বন্দী দশা থেকে মুক্ত স্বাধীন করেছে এবং এর ভিতর দিয়ে ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। কম্যুনিজমের প্রবক্তা কার্ল মার্ক্সও ইতিহাসের এই এগিয়ে যাওয়া বা প্রগতির ধারনাকে ইতিবাচক হিসাবে দেখেন এবং একে কমিউনিজমের পথে যাত্রার পুঁজিবাদী পর্যায় বলে বুঝিয়েছেন। মার্ক্সের ভিতরে তাই পুঁজি ব্যবস্থা এবং শ্রমিকের শ্রমের উপর দখলদারী ব্যতীত আধুনিকতা এবং আলোকায়নের তেমন পর্যালোচনা দেখা যায় নাই। অর্থাৎ মার্ক্স ঠিক এই ক্ষেত্রে অপর্যাপ্ত, অসম্পূর্ন এবং কিছু ক্ষেত্রে ভূল। আধুনিক ক্ষমতা কিভাবে নিজেকে প্রয়োগ করে, তার গতিতত্ত্ব সম্পর্কে বুঝতে আমাদের অন্যান্য পশ্চিমা ও অপশ্চিমা চিন্তকদের কাছে যেতে হবে।

ফরাসী সমাজতত্ত্ববিদ ও চিন্তার ইতিহাস ও বয়ান বিশ্লেষক মিশেল ফুকো তাঁর ‘পাগলামির ইতিহাস’ বইয়ে আধুনিকতার উন্মেষ কালে ক্ষমতার কিছু বিশেষ গুরুত্ত্বপূর্ন দিক আলোচনা করেছেন। প্রান-ক্ষমতা (Biopower) এই দিকগুলির ভিতরে বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। সেখানে তিনি ফরাসী মনরোগ ব্যবস্থাপক ফিলিপ পাইনেলের প্রসংগ টেনেছেন। পাইনেল ফরাসী বিপ্লবের পরে বেশ কিছু পাগলাগারদ পরিদর্শন করেন। সেই পাগল বা উন্মাদদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। তখন উন্মাদ বা পাগলদের শিকলে বেঁধে রাখা হতো। পাইনেল তাদের শিকল থেকে অবমুক্ত করে, খোলা অবস্থায় রাখার ব্যবস্থা করেন। কিন্তু ফুকো দেখিয়েছেন, কেন কিভাবে এই ‘মুক্ত’ করা তো স্বাধীনতা নয়ই, বরং নতুন ধরনের বন্দীত্ব বা পরাধীনত্ব। পাগলকে শিকলের বেড়ি থেকে মুক্ত করলেও, তাকে অন্য পাগলের পাগলামির সামনে এনে রাখা হতো যেন তার নিজের সম্পর্কে অপরাধ বোধ তৈরি হয়। পাইনেলের মতো যারা এই ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন, তাদের মনোরোগ সম্পর্কে জ্ঞান পর্যাপ্ত হোক বা না হোক, তারা যে এর নিয়ন্ত্রক ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নাই। পাগলের শরীর-মন-দেহ ছিল সেই নিয়ন্ত্রন ক্ষমতার মাকাসিদ বা লক্ষ্য। দেহ-মনের উপর এই নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠা আধুনিক ক্ষমতার একটি অন্যতম দিক বলে ফুকো মনে করেন। একেই বায়োপাওয়ার নফসীয় বা প্রান ক্ষমতা বলা হয়। আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, ওষুধ কোম্পানী, হাসপাতাল, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়, চিকিৎসা শাস্ত্র অধ্যয়ন কেন্দ্র বা মেডিকাল কলেজ আদতে এই প্রান ক্ষমতা প্রয়োগ এবং নিয়ন্ত্রনের একেকটি কেন্দ্র বৈ আর কিছু না। যেখানে চিকিৎসার অন্তরালে নাগরিক মানব শরীরের উপর শাসন এবং নিয়ন্ত্রনই মূখ্য। ফুকোর কথার সত্যতা আমরা দেখতে পাই জন্ম নিয়ন্ত্রন, টিকাদান কর্মসূচী, প্রাক আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্পর্কে ভীতি ছড়ানোর মাধ্যমে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রচার-প্রসার, ইত্যাদি সরকারী ও বেসরকারী কর্মসূচীর ভিতর। আবার বিখ্যাত ‘সমাজ রক্ষা করতেই হবে’ (Society must be defended) বক্তৃতায় ফুকো উল্লেখ করেছিলেন যে, এই নফসী-ক্ষমতা (biopower) শুধু ডিসিপ্লিনারী বা নাগরিক ব্যক্তির উপর নিয়ন্ত্রনমূলক ব্যবস্থাপনার ভিতরেই সীমাবদ্ধ না। নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা বা ডিসিপ্লিনারী ক্ষমতা যখন মানুষের জ্ঞান, শিক্ষা, সামাজিকতা, সরকারী ট্যাক্স ইত্যাদি নিয়ন্ত্রন করে, সেখানে প্রান বা নফসীয় ক্ষমতার লক্ষ্য মানুষের শরীর বা দেহকে নিয়ন্ত্রনের উপলক্ষ্য বানানো। ফুকোর মতে নফসীয় ক্ষমতার ভিতরে কিছুটা হলেও ইতিবাচকতা আছে, শরীরকে অসুস্থতা মুক্ত করা, সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা, নাগরিকদের উন্নয়ন ইত্যাদি ইতিবাচক বয়ান তৈরি করেই এই নিয়ন্ত্রন কার্যকর হয়। তবে এর ভিতরে পুরা জনগোষ্ঠী ধ্বংসের মুখে পতিত হবার সম্ভাবনা যে নাই, তা না। তবে বায়োপাওয়ারের আলাপে এই নেতিবাচক দিক অর্থাৎ ধ্বংস ও মৃত্যুর আলাপ ফূকোর চিন্তায় তেমন পরিনত ভাবে ধরা দেয় নাই।  

ফরাসীরা ব্রিটিশদের পাশাপাশি প্রধানতম উপনিবেশী শক্তি। আফ্রিকায় তাদের উপনিবেশ অনেক বিস্তৃত ছিল। ফুকো ফরাসী। সেই দিক দিয়ে ক্যামেরুনী তাত্ত্বিক আশিল এম্বেম্বে আফ্রিকান হওয়ায়, অভিজ্ঞতার দিক থেকে উপনিবেশকে আরো মর্মে মর্মে অনুধাবন করতে যে পারবেন, সেটা স্বাভাবিক। উপনিবেশী শক্তি যে অবিচ্ছিন্নভাবে উপনিবেশ পরবর্তী কালেও নানারুপে আধুনিক রাষ্ট্র এবং আন্তঃ রাষ্ট্রীয় বৈশ্বিক রুপে বিরাজ করছে, তার নানাদিক তুলে ধরার সুযোগ পেয়েছেন এম্বেম্বে। আরো গুরুত্ত্বপূর্ন দিক হলো, ৯/১১ পরবর্তী সন্ত্রাসের (ইসলামের) বিরুদ্ধে যুদ্ধ তাঁর অভিজ্ঞতাকে সমৃদ্ধ করেছে। বলা যেতে পারে উনি ফুকোর নফসী-ক্ষমতা বা biopower এর বিশ্লেষনকে আরো গভীরে নিয়ে যেতে পেরেছেন, প্রসারিত করেছেন তাঁর Necropolitics বা লাশতন্ত্রের বয়ানের ভিতর দিয়ে। উপনিবেশে কোন উপনিবেশী শক্তি নফসী ক্ষমতাকে পরিবর্তিত করে কিভাবে ও কেন প্রয়োগ করে, তার কি ফলাফল, কোন বিশেষ পর্যায় পর্যন্ত নফসীয় ক্ষমতা সীমাবদ্ধ- এই আলোচনার ভিতর দিয়েই লাশতন্ত্রের রুপ লাভ করেছে এম্বেম্বের আলাপে। প্রানের উপর নানাবিধ নিয়ন্ত্রন ও ব্যবস্থাপনার ভিতর দিয়ে নফসী ক্ষমতা প্রয়োগ করা হয়। এই প্রান ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রন পরিবর্ধিত পরিবর্তিত হয়ে লাশতন্ত্রের ভিতর দিয়ে মৃত্যু ও লাশের উপর ব্যবস্থাপনা ও নিয়ন্ত্রনে পরিবর্তিত হয়। জীবন-প্রান বা শরীর নিয়ন্ত্রন নয়, বরং মৃত্যু-খুন ও লাশ ফেলার ক্ষমতাই হলো লাশতন্ত্রের উপজীব্য। ‘মিশেল ফুকো বায়োপাওয়ার বলতে কী বোঝাতে চেয়েছিলেন: যার উপর ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেছে, জীবনের সেই ক্ষেত্র।  কিন্তু কোন বাস্তব অবস্থার অধীনে হত্যা করার, বাঁচতে দেওয়ার বা মৃত্যুর সামনে আসার অধিকার প্রয়োগ করা হয়? এই ক্ষমতা কার অধিকারে? যার জীবন কেড়ে নেওয়া হলো এবং যেই শত্রুতা মৃতকে তার খুনীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়েছিল, তার সম্পর্কে এমন ক্ষমতা কি বলে? যুদ্ধ, প্রতিরোধ, সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ইত্যাদি বিষয়ের অন্তরালে প্রতিপক্ষকে ধ্বংস বা নির্মূল করাই যে রাজনৈতিকতার মূল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য, সে বিষয় বুঝতে নফসী ক্ষমতা কি যথেস্ট? সর্বোপরি, যুদ্ধ যেমন হত্যা করার অধিকার প্রয়োগের উপায়, তেমনি সার্বভৌমত্ব অর্জনেরও একটি উপায়। রাজনীতিকে যুদ্ধের একটি রূপ হিসাবে কল্পনা করে, আমাদের অবশ্যই জিজ্ঞাসা করতে হবে: এতে জীবন, মৃত্যু এবং শরীরের স্থান কোথায় (বিশেষ করে আহত বা নিহত দেহ)? ক্ষমতার কাঠামোতে তাকে স্থাপন করা হয় কিভাবে?’[v] 

লাশতন্ত্র (Necropolitics) বই এর প্রথমেই এম্বেম্বে দেখান গনতন্ত্রের লম্বা লম্বা কথা আসলে ফাঁকি ছাড়া আর কিছু না। গনতন্ত্র মানুষের জীবনে শান্তি সমৃদ্ধি নিরাপত্তা আনে – এসব বুলি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়েছেন এম্বেম্বে। আমেরিকাতেও প্রথম দিকে গনতন্ত্র এবং দাস ব্যবস্থা এক সাথেই ছিল। এই কারনেই “ কালো পূনঃনির্মান” (Black Reconstruction) রচনায় বি-উপনিবেশী তাত্ত্বিক দ্য বোয়া মার্কিন গনতন্ত্রকে শর্ষের ভিতরেই ভূত হিসাবে উল্লেখ করেন। এই দাস ব্যবস্থাপন্থী গনতন্ত্র ছিল সাদাদের জন্যে সাম্য, কিন্তু কালোদের জন্যে চূড়ান্ত অসাম্য। কালোদের জীবন-মরন নিয়ন্ত্রন করতো থমাস জেফারসনের মতো দাস মালিকরা, যিনি আবার খুবই প্রভাবশালী মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এম্বেম্বে আরো নানা রকম উদাহরন দিয়ে ব্যাখ্যা করেন যে, গনতন্ত্র সহ নানা শাষনব্যবস্থার প্রতিটা উদাহরনের ভিতর কমন বা সাধারন দিক হলো, তীব্রতম জুলুমতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যেন, তা শত্রুকে যে কোন উপায়ে ধ্বংস করতে পারে। আইনী বা বেআইনি- যাই হোক। অধিকার রক্ষা হোক বা না হোক। আইন বা অধিকার এইখানে কোন ইস্যুই না। মূল বিষয় হলো কে প্রানে রক্ষা পাবে, আর কে পাবে না- এই সিদ্ধান্ত নেওয়া। উনি সন্ত্রাসী এবং সন্ত্রাস নির্মুলের লক্ষ্যে পরিচালিত গনতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দিকে ইঙ্গিত দেন। এই দুই রুপের কোনটাও আইন এবং অধিকারকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয় নাই। সবার জন্যে সমান ভাবে আইন এবং অধিকারের সংরক্ষন লাশতান্ত্রিক গনতান্ত্রিক ক্ষমতা সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করেছে, যা আমরা ৯/১১ ধটনার ভিতর দিয়ে প্রত্যক্ষ করি। কে আইনী সুরক্ষা পাবে, আর কে এর বাইরে থাকবে- তার সিদ্ধান্ত গ্রহন করতে দেখা গিয়েছে গনতন্ত্র রক্ষার নামে। গনতন্ত্রের নানা আত্ম-বিরোধী দিক চিহ্নিত করে এম্বেম্বে উল্লেখ করেছেন, মার্কিন ক্রীতদাস প্রথা বান্ধব গনতন্ত্রে যেমন ‘সাম্য’ নীতি হিসাবে আত্মবিরোধী, তেমন আসলে যে কোন সমাজের জন্যেই। কারন যে কোন গনতন্ত্রেই সাম্য এবং মানবিক মর্যাদার অধিকার সম্পন্ন ব্যক্তি মানুষ বা নাগরিক থাকে, যাদের আইন ও অধিকার সংরক্ষিত হয় সেই ব্যবস্থায়। এর বিপরীতে এমন এক দল মানুষ থাকে যারা ব্যক্তি নাগরিক হয়েও আইন অধিকার বঞ্চিত জিন্দা লাশ, রাস্ট্রীয় খতমের টার্গেট। এরা হতে পারেন অভিবাসী, আদিবাসী, প্রান্তিক সম্পত্তিহীন, নেশাশক্ত, উন্মাদ, ইসলামপন্থী, পতিত, ধর্মীয়, নিম্নবর্গ ইত্যাদি। এমনকি বৈশ্বিক আবহাওয়ার পরিবর্তনের কারনে উষ্ণতার বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রসীমার কাছে অবস্থিত দেশগুলির গনমানুষের জীবন বিপন্ন হওয়ার বিষয়টাও লাশতান্ত্রিক রাজনীতির অন্তর্গত। পুঁজিবাদী নিওলিবারেল অর্থনীতি ও উৎপাদন ব্যবস্থার ভিতর ভোগ্যপন্যের চাহিদা বিতরনের বিশেষ কিছু দিক সুস্পস্টভাবে বৈশ্বিক ভাবে আবহাওয়ার এই বিপর্যয়ের কারন। আবহাওয়া বিপর্যয়ের মূল উৎস সিএফসি গ্যাস তৈরি হয় যেই শিল্পন্নোত দেশগুলিতে, এরাই আবার ২১ শতকীয় লাশতান্ত্রিক ক্ষমতার দিক থেকে সবচাইতে শক্তিশালী বৈশ্বিক মোড়ল, যাদের পরিচালিত গ্লোবাল অর্থনীতিকে এম্বেম্বে লাশতান্ত্রিকতার অর্থনীতি হিসাবে চিহ্নিত করেন।    

লাশতন্ত্রের একটি গুরুত্ত্বপূর্ন বৈশিষ্ট্য হলো, উপনিবেশী চৈতন্যের বুনিয়াদী মৌলিকত্বকে বিকশিত করে আধুনিক দুনিয়াতে পুঁজিবাদের নিও লিবারেল দশার ভিতরে পরিস্কারভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পারা। গনতন্ত্র এবং উপনিবেশ একই স্বত্ত্বা, মোটেও ভিন্ন কিছু না। এম্বেম্বে লিখেছেন, The colony is not external to democracy and is not necessarily located outside its wall. Democracy bears the colony within it, just as colonialism bears democracy, often in the guise of a musk। উপনিবেশী চৈতন্যের বুনিয়াদী এই মৌলিক দিকটি হলো রেসিজম বা বর্নবাদ, যা গনতন্ত্রেও পূর্নমাত্রায় সংক্রামিত। রাষ্ট্র এবং বৈশ্বিক দুনিয়া যে ভাবে মানুষ বা নাগরিকদের বিভক্ত করে তার উপর লাশতান্ত্রিক ক্ষমতা প্রযুক্ত হয়, তাকে সূক্ষ বর্নবাদ বা Nanoracism এর ভিত্তিতে বুঝা যেতে পারে। প্রচূর পরিমানে অভিবাসী মানুষ পশ্চিমে আছেন আইনী অথবা বেআইনিভাবে। বৈশ্বিক অর্থনীতি একদিকে যেমন সস্তা শ্রমিক চায়, যারা স্বদেশে বসে সস্তা শ্রম দিয়ে কম মূল্যের পোশাক তৈরি করবে, তেমনি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে স্বস্তা শ্রমের চাহিদা মেটানোর জন্যে প্রচুর পরিমানে মানুষ অভিবাসন প্রক্রিয়ার ভিতর দিয়ে বৈধ ভাবে পশ্চিমা দেশগুলিতে দেশান্তরিত হয়। এই অভিবাসীরা সূক্ষন বর্নবাদের খপ্পরে পরে। তারা বিদেশেও হেজিমনিক বা প্রাধান্যবিস্তারকারী ক্ষমতার ভাগ পায় না, আবার স্বদেশ মাটিও আর তাদের কপালে জোটে না। আবার এই অভিবাসিদের ভিতর যারা মুসলিম, তাদেরকে মুসলমানিত্বের কারনে আলাদাভাবে দেখা হয়। তাদের উপর লাশতান্ত্রিক ক্ষমতাধারীরা গোয়েন্দাগিরি করে, নজরদারীতে রাখে, সহজেই আইনী খড়গের শিকারে পরিনত করা হয়, সামাজিক এবং অর্থনৈতিকভাবেও বৈষম্যের স্বীকার হয় তারা। অভিবাসী শিশুদের শিক্ষা ব্যবস্থার ভিতর নিজ সংস্কৃতি-মূল্যবোধ থেকে আলাদা করে ‘সভ্য’ বানানো হয়। ক্ষমতার এই প্রক্রিয়াগুলিতে মুসলিমরা পরিনত হয় ক্ষমতাধরদের অধীনস্থ। বর্নবাদী পৃথকীকরনের ভিতর দিয়েই বাছাই হয় কাদের প্রান ও জীবন এক পর্যায়ে মৃত্যু ও লাশতান্ত্রিক ক্ষমতার ভিতর কুক্ষিগত হবে। এম্বেম্বের ভাষায়, ‘subjugation of life to the power of death’। লাশতান্ত্রিক রাজনীতিতে নানা রকম স্থানিক কেন্দ্র বা স্থাপনার কথা টেনেছেন এম্বেম্বে। উদ্বাস্তু শিবির, বৃদ্ধাশ্রম, কারাগার, ক্যাম্প, ইত্যাদি হলো সেসব সেই সকল স্থান যেখানে মূল সমাজে অনাকাঙ্খিত জ্যান্ত মরার দল আমৃত্যু স্থায়ী জন্ত্রনাদায়ক জীবন যাপন করে অথবা নিছক মৃত্যুর অপেক্ষায় থাকে। কারাগারে ফাঁসীর অপেক্ষায় বন্দী কন্ডেমড সেলে ঠিক এভাবেই অপেক্ষা করে। সূক্ষ বর্নবাদের বড় উদাহরন ফিলিস্তিনী জনগনের উপর চলতে থাকা ভয়াবহতম বর্নবাদী নিপীড়ন। যা শুধু কিছু ঘটনা না, বরং একটা সার্বিক বর্নবাদী ব্যবস্থার ভিতরে মৃত্যুর পরোয়ানা দিয়ে ফিলিস্তিনীদের বন্দী করে ফেলা।

লাশতান্ত্রিক সমাজে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র নিজেই যে শুধু মৃত্যুর পরোয়ানা প্রদানের একচেটিয়া সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, তা না। রাষ্ট্রীয় খুন- সন্ত্রাসের সম্মতি উৎপাদন ও ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনে জনগনের একাংশ অথবা কোন সশস্ত্র অনুগত সরকারী বা বেসরকারী বাহিনীও শরিক হয়। অস্ত্র ধারনের অধিকারও ক্ষমতা বরাবর নির্ধারিত হয়। কোন লাশ পরলে তার আইনী বা নৈতিক যথার্থতা প্রদানের ক্ষমতাও লাশতান্ত্রিক ক্ষমতাবানের। ক্ষমতাধরেরাই এই বয়ান নির্মান করে। আইনী বা আইন বহির্ভূত যে কোন উপায়ে অনাকাঙ্খিত কোন শত্রু জান কবজের ক্ষমতাই, কে ক্ষমতাবান- তা নির্ধারনের একমাত্র চাবিকাঠি হয়ে উঠে। এই পর্যায়ে আমরা শাপলা-শাহাবাগ দ্বৈরথে নফসীয় ক্ষমতা এবং লাশতান্ত্রিক ক্ষমতার প্রভাব পর্যালোচনা করবো।

৫।

আমরা এই পর্যায়ে ক্ষমতার বিন্যাস সম্পর্কে আমাদের বুঝাপড়াকে হালনাগাদ করতে ৭১ থেকে ২০১৩ হয়ে শাহাবাগ-শাপলা পর্যন্ত ভ্রমনে প্রয়াসী হব। আমরা দেখেছি কিভাবে ধর্ম বা ইসলামী রাজনৈতিকতা বিরোধী কামালবাদী ইতরোচিত বা উগ্র সেক্যুলারতন্ত্রের উন্মেষ কাল ছিল ৪৭ এর আযাদীকাল। পর্যায়ক্রমে তা ৭১ এ পরিপূর্নতা লাভ করে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ভিতর দিয়ে। অথচ যে কোন অর্থেই ৭১ এর রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার মানে এই নয় যে, ৪৭ এর আযাদীর মূল রাজনৈতিক প্রস্তাব নাকচ হয়ে গেল। ছয় দফা থেকে আওয়ামী লীগের ৭০ এর নির্বাচনী ঘোষনাতেও লাহোর প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে স্বায়ত্তশাসনের কথা বলা হয়। এমনকি ৭১ এর স্বাধীনতার এপ্রিল ঘোষনাতেও লাহোর প্রস্তাবের কথা উল্লেখ ছিল। যদিও সেখানে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের ঘোষনার কথা বাদ দিয়ে শুধু সেক্যুলারিজমের উসুলী বা বুনিয়াদী ভিত্তি ‘সাম্য-মানবিক মর্যাদা-সামাজিক ন্যায়বিচারের’ কথা ছিল। পরে ৭২ এর সংবিধানে ‘সেক্যুলারিজম’ ও ‘বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ’ একসাথে আসে। বলাই বাহুল্য পশ্চিমা রাজনীতি চিন্তার প্রাথমিক ধারনাও যিনি রাখেন, তিনিও বুঝবেন যে- সাম্য, মানবিক মর্যাদা মানেই সেক্যুলারিজম। তৌহিদী রাষ্ট্র বললে যেমন ইসলামী রাস্ট্রকেই বুঝায়, তাতে অর্থের কোনই হেরফের ঘটে না। ঠিক তেমন, সাম্য-মানবিক মর্যাদা-সামাজিক ন্যায়বিচার- এই তিন শব্দকে এক শব্দের ভিতর প্রকাশ করার তাগিদে সরাসরি ‘সেক্যুলারিজম’ বলা হয়েছে ৭২ এর সংবিধানে, যা আদতে ভিন্ন শব্দ দিয়ে একই অর্থ প্রকাশ করা। অথচ আজকাল দেখা যায় গুড সেক্যুলারেরা প্রায়ই বলে ৭১ এর ঘোষনায় সেক্যুলারিজম ছিল না। ৭২ ঘোষনায় প্রথম সেক্যুলারিজম আনা হয়। এভাবে আসলে শব্দের খেলা দিয়ে সেক্যুলারেরা ইসলামীদের নিয়ন্ত্রন করে, যেন ইসলামীরা না বুঝে হলেও সেক্যুলারিজমের ফাঁদে ধরা দেয়। ফুকোর চিন্তা অনুসারে এই শব্দের খেলাও ইসলামীদের মন বা চৈতন্য নিয়ন্ত্রনের ক্ষমতা বা ডিসিপ্লিনারী পাওয়ারের নিদর্শন। মজার বিষয় ৭১ এর এপ্রিল ঘোষণা পত্র লিখিত হবার পিছনে সব চাইতে উল্লেখযোগ্য ভূমিনা পালন করেন ভারতীয় ব্যারিস্টার, ইন্দিরা গান্ধীর কাছের মানুষ সুব্রত রায় চৌধূরী। যিনি তাঁর বিখ্যাত বই বাংলাদেশের উদয় (Genesis of Bangladesh) এ বিস্তারিত বলেছেন, কেন পাকিস্তানের সংবিধান এবং ইসলামী রাস্ট্রের স্বরুপ বাংলাদেশের সেক্যুলার গণতান্ত্রিক অধিকার এবং ধর্ম নিরপেক্ষ রাজনৈতিক মুক্তির জন্যে হুমকী। ইন্দিরা গান্ধী সুব্রত রায়ের এই বই এর উপর ভিত্তি করেই ইন্দিরা গান্ধীর ইন্ডিয়া স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। উনার মতে পাকিস্তানের সংবিধান শুধু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী মুসলিমদের প্রাধান্য নিশ্চিত করে। তাই বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িক সেক্যুলার করে গড়ে তুলতে ইসলাম বা মুসলমানি চেতনা পরিহার করে তাকে বিশ্বজনীন পশ্চিমা সেক্যুলার কায়দায় গড়ে তোলার কোনই বিকল্প নাই। সুব্রত রায় চৌধুরীর সুযোগ্য শিষ্য আওয়ামী লীগ নেতা ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম নিজের অভিজ্ঞতায় উল্লেখ করেছিলেন কিভাবে ৭১ এর স্বাধীনতার ঘোষনাপত্র লিখা হয়েছিল। তিনি যখন তাজউদ্দীন সাহেবের অনুরোধে ঘোষনা লিখতে বসেন তখন তাঁর মাথায় কাজ করছিলো মার্কিন সংবিধান।  কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, মার্কিন, ইন্ডিয়া এবং ফরাসী সংবিধানের আলোকেই ৭১ এপ্রিল ঘোষনাপত্র তৈরি করা হয়। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের জনগনের দাবীর প্রেক্ষিতে সংবিধান সভায় গৃহিত পাকিস্তান সংবিধানের মৌলিক স্বত্ত্বাগত দিকগুলি পরিবর্তন না করলেও স্বাধীনতা যুদ্ধের বাস্তবতায় তেমন কোন রকমফের হতো না। সাংবিধানিক এই ধারা অব্যাহত রেখেও বাংলাদেশ স্বাধীন করা যেত। আওয়ামী লীগের ছয় দফা বা ৭০ এর নির্বাচনের মেনিফেস্টোতে জনগনের রাজনৈতিক স্বত্ত্বার মৌলিক অবস্থানকে পুরাপুরি অস্বীকার করা হয় নাই। কিন্তু স্বাধীনতার ঘোষনা থেকে ৭২ এর সংবিধানে ইসলামকে কামালবাদী কায়দায় এলিয়েনেট বা বিচ্ছিন্ন করা হয়। যা পরবর্তীতে ধর্মীয় ক্ষমতা উচ্ছেদের মূল কারন বলে মনে করা যেতে পারে। ৪৩ এ ইসলাম বিনাশী লাশতন্ত্রের সূচনা, ৭১ এ এসে ঠিক এইখানেই সে যৌবনপ্রাপ্ত হয়েছে।

সাংবিধানিক এমন পরিবর্তন বা বিকৃতি ঘটানোর ভিতর দিয়ে পাকিস্তানের সংবিধানের ন্যাচারল ও পজিটিভিস্ট আইনের সমন্বয়ী ধারা থেকে পুরাপুরি পজিটিভিস্ট ধারার ধর্মীয় ক্ষমতা নির্মূলের প্রক্রিয়ার ভিতর নব্য বাংলাদেশকে প্রবেশ করানো হয়। এর কারনেই ৭২ এ ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতিকে নিষিদ্ধ ঘোষনা করা হয়। আমরা দাবী করব বাংলাদেশে বিদ্যমান ইসলাম বিরোধী নিয়ন্ত্রণমূলক, নফসীয় ও লাশতান্ত্রিক ক্ষমতার ন্যায্যতার উৎস ঠিক এইখানেই। এম্বেম্বে যে দেখিয়েছেন কিভাবে গনতন্ত্র ফাঁকা বুলি ছাড়া, সাম্যের অন্তরালে অসাম্য তৈরি করা ছাড়া কাজ করতে পারে না, তা আমরা পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের সাংবিধানিক এই পরিবর্তনের ভিতরও পরিস্কার ভাবে দেখতে পাই। সংবিধানে সাম্য সবার উদ্দেশ্যেই আছে কিন্তু বাস্তবে সরকার শাসনের ভিতর দিয়ে সংবিধানের সাথে অসঙ্গতি তৈরি করে অসাম্য তৈরি করছে- বিষয়টা ঠিক এমন না। সাম্যের ধারনার গোড়াতেই পরিপূর্নভাবে অসংগতি বিদ্যমান। এম্বেম্বে আলোচনা করেছেন যে, মার্কিন সংবিধানে সাম্য অর্থ শুধু দাসের মালিকদের জন্যে সাম্য, সেখানে দাসরা সাম্যের আওতা বহির্ভূত। ঠিক সেভাবেই ৭১ এবং ৭২ এ বাংলাদেশের সাংবিধানিক সাম্য হলো শুধু সেক্যুলারদের জন্যে সাম্য। একজন ধর্মহীন বা ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত গনতন্ত্রী এবং একজন ধর্মীয়তা মুক্ত কমিউনিস্ট বাম প্রগতিশীল সেক্যুলার হিসাবে সেক্যুলার বা ‘সাম্য’ ভিত্তিক রাস্ট্রে তাদের রাজনৈতিকতাকে শতভাগ চর্চা করতে পারবে। রাস্ট্রেও সাম্য আছে, কমিউনিস্টও সাম্য চায়। কিন্তু একজন ধর্মভিত্তিক নাগরিক তার ধর্মীয় রাজনৈতিকতা শতভাগ চর্চা করতে পারবেন না রাষ্ট্রে। তাকে সেক্যুলারিজম ভিত্তিক সাম্য মানতে হবে, সংবিধানে আল্লাহর সার্বভৌমত্ব নয়, মানুষের বা রাস্ট্রের সার্বভৌমত্ব মানতে হবে (নাউযুবিল্লাহ)। ধর্মীয় রাজনৈতিকতার সক্রিয়রা তাদের ন্যূন্যতম রাজনৈতিক স্বীকৃতি পাবেন না। এই স্বীকৃতি পাকিস্তানের সংবিধানে ছিল। এই স্বীকৃতি আদায়ে বাংলাদেশের আলেমরাও ভূয়সী অবদান রেখেছিলেন। অথচ ৭১ এর ঘোষনা এবং ৭২ এর সংবিধানে সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন করে ফেলার ভিতর দিয়ে ইসলামী আদর্শকে উপড়ে ফেলে ‘সাম্য’ যুক্ত হয়। ‘সাম্য’ অর্থ সমান। একজন নাস্তিক এবং একজন মুসলমান বা হিন্দু সমান।   বাস্তবে দেখা যায়, এরা সবাই কাছাকাছি কিছুটা সমান হবে যদি ধর্ম, সম্পত্তি, লিঙ্গ এসব বাদ দেওয়া হয়। তো কাদের পরিচয়ভিত্তিক সবকিছু বাদ দিলেও কোনই সমস্যা হয় না? একবিন্দু পরিমান চিন্তা শক্তির অধিকারী যে কেউ বলতে পারে, এরা হলো কমিউনিস্ট, সমাজতন্ত্রী বা প্রগতিশীল। এরা সহজেই ধর্মভিত্তিক আত্মপরিচয় বাদ দিয়ে শুধু ‘মানুষ’ পরিচয় গ্রহন করতে পারে। বামপন্থায় সকল আত্মপরিচয় অগ্রহনযোগ্য। শুধু অর্থনৈতিক অবস্থাই ব্যক্তির পরিচয় হিসাবে যথেস্ট। সে হয় বূর্জোয়া, না হয় শ্রমিক, না হয় ছোট বা পাতি বুর্জোয়া। কাজেই নিছক ‘সাম্য’ ভিত্তিক রাস্ট্র শুধু বাম ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীলরা চাইতেই পারে। ‘সাম্য’ ই প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষদের ধর্ম। কিন্তু ধর্মভিত্তিক মানুষেরা সংবিধানে ধর্মিয়তাও চাইবে, যা কিনা সাম্যবাদী বা সেক্যুলারেরা চাইবে না। কাজেই ইসলাম বাদ দিয়ে শুধু সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্র করা মানে ধর্মীয় জনগনের সাথে গোড়াতেই অসাম্য (Inequality and Discrimination) করে ফেলা। শুধু ধর্মীয়ই না, বাঙ্গালী ব্যতীত অন্য নৃগোষ্ঠীর জন্যেও তা বৈষম্যমূলক। সকল বাঙ্গালী বাম গনতন্ত্রী কমুনিস্টদের জন্যে যা সাম্য, মুসলিম, হিন্দু, বৈদ্ধ, খ্রিস্টান, চাকমা, মগ, সাঁওতাল দের জন্যে তা অসাম্য। ৭২ এ সংসদ অধিবেশনেও আমরা তাই চাকমা নেতা এম এন লারমাকে বাঙ্গালী পরিচয় গ্রহন করতে অস্বীকার করতে দেখি। মার্কিন দেশে কালোদের বাদ দিয়েই যেমন শুধু সাদাদের জন্যে গনতন্ত্র ও সাম্যের মূল্যবোধ প্রয়োগ করে হয়েছিল। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও ইসলামীদের বাদ দিয়ে তাই করা হলো।         

শুধু অবাঙ্গালী পাহাড়িরা নয়, সাম্যের ভিত্তিতেই দুনিয়ার এক ভয়াবহতম লাশতান্ত্রিক নির্যাতন নেমে আসে অবাঙ্গালী বিহারী মুসলিমদের উপর। ৪৭ এর আযাদীর সময় বিহারী মুসলিম জনগন সসম্মানে পাকিস্তান ভূমিতে অভিবাসন করেন। বলা যায় মৌলিকভাবে ইনারাই পাকিস্তান মতাদর্শকে ধারন করেছিলেন। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে যেইসব পাকিস্তানীরা পুর্বেই বসবাস করছেন, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু বিহারী মুসলমানেরা নিজেদের বসত ভিটা ত্যাগ করে শুধু পাকিস্তান আদর্শের অনুগামী হয়েই অভিভাষন করেন। তাই তারা এক বিশেষ মর্যাদার অধিকারী (মুহাজির)। হেইদগরের চিন্তানুসারে যাদের অথেন্টিক বা খাঁটি পাকিস্তানী বা পাকিস্তান অন্টোলজির অধিকারী বলা যেতে পারে। আশ্চর্যের বিষয় হলো বঙ্গবন্ধু মরহুম শেখ মুজিবর রহমানই ৪৬ এর দাঙ্গার পরে সহরোয়ার্দী সাহেবের অনুরোধে বিহার পরিদর্শনের সময় বিহারীদের পূর্ব পাকিস্তানে আসার আমন্ত্রন জানিয়েছিলেন।[vi] সঙ্গত কারনেই জান-মাল-মর্যাদা-নিরাপত্তার খাতিরে তারা যুদ্ধে পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন করেন। অথচ যুদ্ধ শুরুর আগেই অর্থাৎ ২৬ শে মার্চের আগেই বিহারী নিধন শুরু করে উগ্র সেক্যুলার সাম্য-মানবিক মর্যাদা সমর্থক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদীরা। এর আগে বছরের পর বছর ধরে বিহারী নিধনের সামাজিক সম্মতি তৈরি করা হয়। এরপর তাদের সম্পত্তি দখল করা, তাদের যত্রতত্র খুন করে ফেলে রাখা হয়- অর্থাৎ বিহারী মুসলিমদের উপর চালানো হয় গনহত্যা।  রেল লাইনে ফেলে রাখা বিহারী লাশের পরিচয় পর্যন্ত গুম করে, সেই লাশকে পাকিস্তানী ও বিহারীদের হত্যা করা বাঙ্গালীর লাশ বলে পর্যন্ত বিশ্ব দরবারে প্রচারনা চালানো হয়। ৭১ এর পরে এই বিহারীদের জীবনে নেমে আসে গভীরতম মানবিক বিপর্যয়। তাদের সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে ধুকিয়ে দেওয়া উদ্বাস্তু শিবিরে। এম্বেম্বে মার্কিন দাসপ্রথা এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধে গনহত্যার শিকার কালো ও ইহুদীদের সাথে তুলনা দিয়ে বলেন, ‘হাল দুনিয়ায়, নিগ্রো এবং ইহুদীরা অন্য নামে পরিচিতঃ ইসলাম, মুসলমান, আরব, ভিনদেশী, উদ্বাস্তু, অবৈধ প্রবেশকারী ইত্যাদি হলো তাদের কয়েক প্রকার’।[vii] ৭১ এ লাশতান্ত্রিক রাজনৈতিকতার ফলাফল হিসাবে নিজভূমে পরবাসী হয়ে যাওয়া বিহারী মুসলমানেরাও এই কাতারে যে থাকবে, তাতে সন্দেহের অবকাশ নাই।

 
পাকিস্তান আমলে ক্ষমতার রুপকে ফুকো বর্নিত ডিসিপ্লিনারী বা নিয়ন্ত্রনমূলক এবং নফসীয় ক্ষমতা বা বায়োপাওয়ার বলা যাতে পারে। পাকিস্তান ভিত্তিক সামরিক আমলাতান্ত্রিক ক্ষমতাও লাশতান্ত্রিক ছিল না। নাগরিকদের নির্মূল করাকে প্রাধান্য দেওয়া হয় নাই। এমনকি দেখা যায় রাষ্ট্র বিরোধী ষড়যন্ত্রের অভিযোগেও কাউকে গুম করে ফেলা হয় নাই। সেমন, রাষ্ট্র বিরোধীতার অভিযোগে শেখ মুজিবর রহমানকে অভিযুক্ত করা হলেও, আন্দোলনের পরে মুক্ত করা হয়। অথচ আশ্চর্য এই যে, পাকিস্তান আমলেই লাশতন্ত্রের সূচনা হয় পাকিস্তান বিরোধী বাঙ্গালী সেক্যুলারদের হাতেই। বাঙ্গালীদের বাসনায় এমন এক শত্রুর কল্পনা করা হয়, একমাত্র নির্মুল ও ধ্বংসের ভিতর দিয়েই যার বিনাশ সম্ভব। বলাই বাহুল্য এই শত্রু হলো ইসলামপন্থীরা। বাসনার এই বিশেষ বর্নবাদী রুপকেই এম্বেম্বে বলেছেন, ‘The desire for an enemy, the desire for apartheid for separation and enclaving, the fantasy of extermination- all today occupy the space of this enchanted circle’ লাশতান্ত্রিক ক্ষমতা লাশ বানানোর মতো শরীর বা নফস খোঁজে। খুনীর লাশ ফেলার বাসনা, খুন হয়ে যাওয়া লাশ বা নফসের অগ্রগামী। আমান্ডা মাচিন তাঁর “জাতীয়তাবাদ” নামক প্রবন্ধে  ফরাসী ঐতিহাসিক আর্নেস্ট রেঁনোর কথা উল্লেখ করেছেন। রেঁনো জাতীয়তাবাদ বিষয়ে বিখ্যাত “জাতি কি” রচনায় জাতি রাস্ট্রের উদয় কালে প্রাণঘাতী সহিংসার কথা টেনেছেন, ‘unity is always effected by means of brutality’। রেঁনোর মতে উদয়ের সেই রক্তাক্ত খুনে নৃশংসতা একসময় ভুলে যায় মানুষ। একই প্রবন্ধে মাচিন জাতীয়তাবাদ বিশেষজ্ঞ আরেক বিখ্যাত চিন্তাবিদ বেনেডিক্ট এন্ডারসনের বরাতে আরো জানান, এই যে মানুষ দুঃসহ সেই নৃশংসতাকে ভুলতে চায়, তা আসলে মনে করারই নামান্তর।[viii] উল্টিয়ে বললে, যা কিছু মনে রাখলে আমরা আত্মবিরোধে উপনীত হই, তাকেই আসলে আমরা ভুলতে চাই। এখানেই ভুলে যাওয়া আর মনে রাখা মিলিত হয়ে পরে একই বিন্দুতে। এখানেই প্রাসঙ্গিক হয়ে আসে সেই ‘শত্রু’কে চিনে রাখা,  যাকে নির্মুল করার সহিংস বাসনা এবং সক্রিয়তা এই জাতীয়তাবাদী সেক্যুলার কর্তাসত্ত্বাকে মূর্ত করে তোলে। ভয়ঙ্করতম এই কাল্পনিক শত্রুর মোকাবেলা করাই একমাত্র নিয়তি হয়ে দাঁড়ায় জাতির। এই তথাকথিত শত্রু এতই ভয়ঙ্কর যে তার বিনাশ না হওয়া মানে নিজের বিনাশ হওয়া। লাশ ফেলার কর্তা বারবার সতর্ক, অস্থির (Anxiety) থাকে নিজের অপরিপূর্ন অস্তিত্ত্বকে টিকিয়ে রাখতে। নিজ অস্তিত্ত্বের ঠাহর নিজেই করে আর পেরে উঠে না সে। সে তার আমিত্ত্বকে পরিপূর্ন হিসাবে দেখতে পায় নাই। অপূর্ন থাকে। সেই অপূর্নতা পূর্ন করলেই যেন তার আমিত্ত বা ইগো পরিপূর্ন হতে পারে। এই পর্যায়ে সে এমন ভয়ঙ্কর কোন কিছু (এই দিককে এম্বেম্বে ‘The terrifying object’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন) বলে কল্পনা করে বসে, যার বিনাশ সাধন করার বাসনা দিয়ে নিজের অসম্পূর্ন অস্তিত্ত্বকে পরিপূর্ন করার কল্পনা করা যেতে পারে। তবে কল্পলোকের এমন শত্রুর অস্তিত্ত্ব বাস্তবের সাথে মিলে না। বাস্তবতার সাথে যদি খুনীর লাশ ফেলার গ্রহনযোগ্যতার সম্পর্ক না থাকে, তাহলে খুন কারো কাছে গ্রহনযোগ্য হবে না, লাশ ফেলার যৌক্তিকতা দেওয়া যাবে না। তাই বিকট নৃশংস শত্রুর ছবি এঁকে সে নিজের কল্পনাকে সাজায়। শত্রুকে এমন ভয়ঙ্করতম ভাবে সাজানোর কল্পনা করার প্রক্রিয়া এতই শক্তিশালী যে, এই বাসনা খুনীর চারপাশে খুন করে লাশ ফেলে দেওয়ার স্থানিক আবহ তৈরি করে, যেই অবস্থানে বা জায়গায় খুনীরা খুনের সাফাই গায়, খুনীদের সাথে মিলিত হয়, নতুন খুনী তৈরি করতে থাকে। তৈরি হয় খুনী ভ্রাতৃত্ব। এই স্থানে পৌনঃপুনিকভাবে তৈরি হতে থাকে খুনের গল্প,শত্রুর কল্পনা। কখনো সে সামন্তমনা, সাম্প্রদায়িক, কখনো স্বাধীনতা বিরোধী, কখনো ধর্ম নিরপেক্ষতার শত্রু, যুদ্ধপরাধী, জাতিবাদী, পরিচয়বাদী, কখনো বা জঙ্গী, জামায়াত-শিবির বা হেফাজতি। শাহাবাগের ব্যস্ত মোড় এমনই এক তাৎপর্যময় স্থান হিসাবে দাঁড়িয়ে যায়। অপরদিকে খুব কাছেই শাপলা চত্বর হয়ে দাঁড়ায় এমন স্থান, যা বদ্ধ ভূমি, ফাঁসীর মঞ্চ বা ফায়ারিং গ্রাউন্ডের মতো বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়। দিনের পর দিন ধরে চলতে থাকে শাহাবাগ গনজাগরন মঞ্চ পুলিশী পাহাড়ায়, অথচ শাপলা চত্বর বধ্যভূমির জন্যে বরাদ্দ সময় ২৪ ঘন্টাও পার হতে পারে না। শাপলা নামের বিশেষ এই স্থান থেকে বিদ্যুৎ-আলো বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। খতমের উৎসবের পরে মিনিসুপালিটির পানির গাড়ী ব্যবহার করে পরিস্কার করে ফেলা হয় রক্তের দাগ। অপরদিকে খুন হওয়া রক্তাক্ত আলেমদের লাশ নিয়ে মশকারি করে দেখানো হয়, পালানোর অপেক্ষায় রঙ মেখে শুয়ে থাকা অথর্ব মানুষ হিসাবে। যখন যেভাবে জনগনকে খাওয়ানো যায়, সেভাবে বারবার একই শত্রুর কাল্পনিক নির্মান আর তাকে ঘায়েল করার খুনে জিঘাংসা তৈরি চলমান থাকে ধর্মনিরপেক্ষ সাম্যভিত্তিক লাশতন্ত্রে, যা নিছক সাংস্কৃতিক অপরায়ন দ্বারা ব্যাখ্যা করা যাবে না।

       
৪৭ এর আজাদিরও আগে ৪৩ সালেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ হন মুসলিম লীগপন্থী ছাত্রনেতা নাজির হোসেন। প্যারাডক্সিকাল বিষয় হলো, তিনি সাম্প্রদায়িক মারামারি থামাতে গিয়ে এক হিন্দু ছাত্রের ছুরিকাঘাতে শহীদ হন। শুধু তাই না, নাজির আহমেদের শাহাদাতের স্মরণ সভা ১৯৪৪ থেকে ৫২ পর্যন্ত আয়োজন করা গেলেও, এর পরে আর আয়োজন করতে দেওয়া হয় নাই। সে সময়ে উলটা উনাকেই সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী হিসাবে আখ্যা দিয়ে স্মরণ সভার চল বন্ধ করা হয়। একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে, যখন বিতর্ক আলোচনা অনুষ্ঠানে ধর্ম নিরপেক্ষ শিক্ষা ব্যবস্থার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে আলোচনা করতে গেলে বামপন্থী ছাত্রদের আক্রমনে শহীদ হন ইসলামপন্থী তূখোড় মেধাবী ছাত্র সংঘ নেতা আব্দুল মালেক। আলোচনা তর্ক অনুষ্ঠান কিভাবে পরিনত হতে পারলো খুনের উৎসবে? তখনও তো ইসলামপন্থীরা রাজাকার হয়ে উঠে নাই। বরং সেক্যুলারদের সাথে একই কাতারে ৬৯ এর গনআন্দোলনে সামিল ছিল। ইসলামপন্থীরা যে সেক্যুলার প্রগতিশীলদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিনত হয়েছিল তা স্বাধীনতার গৃহযুদ্ধের অনেক আগেই শুরু হয়েছিল। এমনকি বিহারী মুসলিম গনহত্যাও তাই। কাজেই ইসলামপন্থা নির্মুলের লাশতন্ত্র তাই অনিবার্যভাবে ৭১ এর ফসল না, বরং তারও অনেক পূর্বের- এই দাবী ঐতিহাসিক সত্য। এভাবে বাংলার লাশতান্ত্রিক বাসনা যখন দানা বেঁধে উঠছিল, তখন তা এতই ধ্বংসাত্মক খুনে ছিল যে, পাকিস্তান রাস্ট্রের কোনই পৃষ্ঠপোষকতা লাগে নাই। বরং যারা এই নৃশংসতার শিকার তারাই রাস্ট্রের পক্ষের ছিলেন। কাজেই আমরা দেখতে পাচ্ছি বাংলাদেশ রাস্ট্রের উদয়ের মর্মে ইসলামী রাজনৈতিকতার প্রকাশ ইসলামপন্থাকে খতম, বিনাশ ও নির্মূল করার বাসনা ঐতিহাসিকভাবে সত্য। একে এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নাই। বিজয় দিবসের সেই দিনে অর্থাৎ ১৬ই ডিসেম্বরে আমরা দেখি নাজির, মালেক হত্যার লাশতান্ত্রিক খুনের পরবর্তী পর্ব। জেনেভা কনভেনশন, যুদ্ধের নীতি, অপরাধ আইন ইত্যাদি সকল প্রকার ডিসিপ্লিনারী ক্ষমতার নানা রুপকে সম্পূর্ন অগ্রাহ্য করে গ্রেফতার করা হাত পিছমোড়া করে বাঁধা অবস্থায় জনসম্মুখে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হয় যুদ্ধাপরাধ, রাজাকারীর অভিযোগে অভিযুক্ত বেশ কয়েকজন পাকিস্তানপন্থীদের। শুধু হত্যা না, এই ঘটনা ছিল হত্যার প্রদর্শনী, ক্যামেরার সামনে লাশতান্ত্রিক প্রদর্শনকামীতা। পরে দেখা যায়, ৯০ এর দশক থেকে নিয়মিত ভাবে ঘৃনার সাথে উচ্চারিত হতে থাকে কথা সাহিত্য কল্পকাহিনী উৎসারিত বা ফিকশনাল ‘তুই রাজাকার’ শ্লোগান। কে রাজাকার, কেন রাজাকার, রাজাকারের রাজনৈতিক স্বত্ত্বা, তার আদর্শিক উছিলাগত ইতিহাসের ন্যায্যতা, অধিকার সব কিছু ভাসিয়ে দেয় নিরন্তর জীঘাংসা জন্ম দেয় এই শ্লোগান। এমনকি স্বাধীনতার গৃহযুদ্ধের ৫০ বছর পরেও বিশ্বজিত, আবরার এবং যারা ৭১ এ ভ্রুনশিশু হিসাবেও জন্মায় নাই, তারাও খুন হতে থাকে এই ‘রাজাকার’ নামক কাল্পনিক শত্রুর টাইটেল প্রাপ্ত হয়ে। আর খুনীর দূর্গের সাইনবোর্ড টাঙ্গানো থাকে সাম্য-মানবিক মর্যাদা-ন্যায়বিচার-স্বাধীনতা-সেক্যুলারিজম-প্রগতিশীলতা-বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। শাহাবাগে ইসলামপন্থা খতমের এই তীব্র আবেগকে একজন স্যাডিস্ট ধর্ষকামীর বিকারগ্রস্থ যৌন ভাবাবেগের সাথে তুলনা করা যেতে পারে। ৪৩, ৬৯ এবং ৭১ এও সেই একই ইরোটিক লালসার প্রকাশ আমরা দেখেছি। ৭১ এর কাল্পনিক ঘৃনার ফ্যান্টাসিজাত রাজনৈতিক বাসনা সৃস্ট এই ‘শত্রু’ প্রসঙ্গে এম্বেম্বের মতে, ‘Desire (master or otherwise) is also that movement through which the subject – enveloped on all sides by a specific phantasy [fantasme] (whether of omnipotence, ablation, destruction or persecution, it matters little) – seeks to turn back on itself in the hope of protecting itself from external danger, while other times it reaches outside of itself in order to face the windmills of the imagination that besiege it. Once uprooted from its structure, desire then sets out to capture the disturbing object. But since in reality this object has never existed – does not and will never exist – desire must continually invent it. An invented object, however, is still not a real object. It marks an empty yet bewitching space, a hallucinatory zone, at once enchanted and evil, an empty abode haunted by the object as if by a spell.’[ix]  

অবিরত ভাবে দিনের পর দিন চলতে থাকে স্বাধীনতার শত্রু মিত্র নিয়ে দেশবাসীকে ভাগ করার চেস্টা। সমাজের অভ্যন্তরে এসব নিয়ে মাথাব্যথা প্রায় সম্পূর্ন উবে গেলেও, নির্দিস্ট খুনে রাজনৈতিক গোষ্ঠী এই ঘৃনার পূনরুৎপাদন করতে থাকে লাশ ফেলার উছিলায়। এম্বেম্বের মতে, ‘In this depressive period within the psychic life of nations, the need, or rather the drive, for an enemy is no longer purely a social need. It corresponds to a quasi-anal need for ontology.’[x] ঝগড়া ঠেকাতে গিয়ে নাজির আহমেদকে অথবা বিতর্ক অনুষ্ঠানে আলোচনা করতে গেলে আব্দুল মালিককে খুন হতে হবে কেন? যদি নাজির বা মালেক গুলি করে হিন্দুদের অথবা প্রগতিশীল বামদের খুন করতে যেতেন, তাহলে অবশ্যই আত্মরক্ষার তাগিদে তাদেরকেও আক্রমন করার ন্যায্যতা থাকতো। কিন্তু এখানেই বিস্ময় জাগে আমাদের। এখানে খুন করার অন্য কোন কারনের দরকার নাই, কারন খুনীর অস্তিত্বের মূল বিষয়টিই হলো খুন করে ফেলতে পারার একচেটিয়া ক্ষমতা। এর সাথে কোন সামাজিক রাজনৈতিক কারনের আর যোগ থাকে না, থাকার দরকারও পরে না। ইসলামপন্থীদের খুন না করতে পারাটাই তার অনস্তিত্ত্ব বা অস্তিত্ত্বের জন্যে হুমকি। তাই তার শত্রুর কল্পনা তার অস্তিত্বের জন্যে অপরিহার্য হয়ে পরে। এই কারনেই লাগাতার- অবিরাম-অবিচ্ছিন্নভাবে লাশতন্ত্র কায়েম করে যেতে হয় তাকে। তাই ঐতিহাসিকভাবে লাশতন্ত্রের সকল রুপের ভিতরেই প্রাণঘাতী শত্রুর (Mortal or ontological enemy) ধারনা বা কল্পনা আবশ্যিক হয়ে পরে। ৭১ এর ৫০ বছর পরেও বারবার স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি বা রাজাকার বলে এমন মুসলিমদের খুন করা হতে থাকে যাদের জন্মই ৭১ এর পরে। এমনটা শুরু হয় একতরফা ভাবেই। বাংলাদেশের ইতিহাসে এলিট তথাকথিত প্রগতিশীল ধর্মনিরপেক্ষ সাম্যবাদী বাম শ্রেনীর ভিতর রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিস্টিত হবার আগেই এই চরম ঘৃনা উৎপাদন করতে আমরা দেখি। আলোচ্য বিশেষ উদাহরনে অবশ্যই তথাকথিত কল্পিত প্রাণঘাতী শত্রু ইসলামপন্থা বা ইসলামী রাজনৈতিকতা তথা ইসলাম। প্রাণঘাতী শত্রুতা তাই লাশতন্ত্রের স্বত্ত্বার মর্ম বা Ontological element। সমাজে তাই বিদ্যমান ইসলাম বনাম সেক্যুলারিজমের দ্বন্দ্ব খুবই স্পস্ট বাস্তবতা। সেক্যুলার ইসলামপন্থা বিদ্বেষীরাই এর জন্যে পুরাপুরি দায়ী।

৬।

আগেও বলেছি স্বাধীনতা যুদ্ধ পরবর্তীতে আমরা প্রথমেই দেখি আইন করে ইসলামপন্থা নিষিদ্ধ করা হচ্ছে। এরপর শহীদ গোলাম আজমের নাগরিকতার মামলার উদাহরন দেওয়া যেতে পারে।  আইনী, আইন বহির্ভূত ও বেআইনী আইনী প্রক্রিয়া- এই তিন রুপে ইসলাম বিদ্বেষী লাশতন্ত্র কায়েম হতে দেখা যায়। প্রথম উদাহরন এইমাত্রই দেওয়া হলো। এবার তাহলে দ্বিতীয় ও তৃতীয় রুপ দর্শন করে দেখা যাক। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে আন্দোলন বেআইনী আইনী এবং আইন বহির্ভূত ভাবে লাশতান্ত্রিক হত্যার উৎসবের ভিত রচনা করেছিলো। এরপরে যুক্ত হলো ৯/১১ পরবর্তী সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধ। রাজনীতিতে এই ধারাগুলিসহ পুর্ববর্তী ইসলামপন্থা বিনাশী শক্তিগুলি একসাথে এসে মিলে যেই মোহনায়, সেই মোহনাই শাহাবাগ। জাতীয় লাশতান্ত্রিক শাহাবাগী স্বত্ত্বা মিলে যায় আন্তর্জাতিক লাশতান্ত্রিকতার সাথে। শত্রু কমন। বাংলাদেশে ইসলাম বিনাশী লাশতন্ত্র সব দিক থেকে পরিপূর্নতা পায় শাহাবাগ আন্দোলনে। ক্ষমতার ঠিকুজি অন্বেষনে ফুকো, আগাম্বেন ও এম্বেম্বেকে অনুসরন করে বলা যেতে পারে যে, প্রানহরন বা রক্ষার সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম সার্বভৌম ক্ষমতার রুপ হলো লাশতান্ত্রিক ক্ষমতা। একই সাথে নিয়ন্ত্রনমূলক ক্ষমতা, নফসীয় বা প্রান ক্ষমতাও কার্যকর থাকে। যুগপদ ভাবে সর্বশক্তিতে সকল ক্ষমতা ব্যবহার করে শাহাবাগের হত্যামঞ্চ থেকে সাধারন মুসলিমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল যারা তারাই ইতিহাসে শাহাবাগী বলে কুখ্যাতি পেয়েছে।   

১৮৩৫ সালে আমেরিকার সেন্ট লুই তে কালো ম্যাকিন্টশকে খুনের অভিযোগে কোন গ্রহনযোগ্য বিচার ছাড়াই প্রায় ১০০০ জন লোকের সামনে প্রকাশ্যে শিকল দিয়ে গাছের সাথে বেঁধে আগুনে পুড়ায়ে হত্যা করা হয় খুনের অভিযোগে কোন গ্রহনযোগ্য বিচার ছাড়াই। রেকর্ডকৃত তথ্যে দেখা যায়, ১৮৮৩ সাল থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত যেই ৪৪৬৭ জন কে হত্যা করা হয়েছিল, তার ভিতর ৩২৬৫ জনই ছিলেন কালো।[xi] বাংলাদেশে সংঘটিত লাশতান্ত্রিক ক্ষমতার শিকারে পরিনত হওয়া মানুষের ভিতর সংখ্যার দিক থেকে বড় হলো ইসলামপন্থীরা, এরপর আছে বিভিন্ন যৌজদারী অপরাধের দায় অভিযুক্তরা এবং চীনপন্থী মাওবাদীরা ও জাসদের কর্মীরা। মার্কিন দেশে ম্যাকিন্টশকে খুন করবার পদ্ধতিকে লিঞ্ছিং বলা হয়ে থাকে। কালোদের লিঞ্ছিং এর পিছনে কু ক্ল্যাক্স ক্ল্যান নামক উগ্র বর্নবাদী রাজনৈতিক গ্রুপ দায়ী। এই সংগঠনের সদস্যদের বেশীর ভাগই সাধারন জনগনের ভিতর থেকে এসেছিলো। শাহাবাগীরা মধ্যবিত্ত বাম ও ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরা যেমন যুদ্ধাপরাধী-স্বাধীনতা বিরোধী-রাজাকার-জামায়াত-শিবির-হেফাজতিদের হত্যা-নির্মুল করে দেশকে রক্ষা করতে চায়, ঠিক তেমনই কু ক্ল্যাক্স ক্ল্যান মার্কিন মুলুককে কালোদের হাত থেকে বিশুদ্ধ রাখতে চায়। প্রচুর পরিমানে শাহাবাগীদের পুলিশ বাহিনীতে চাকরী দেওয়া হয়, যাদের মাধ্যমে সরকারী তত্ত্বাবধানে  দেশ জুরে বিশেষ করে খুলনা, সাতক্ষীরা, রাজশাহী, বগুড়া তে ঘটে যায় ইসলামপন্থী নির্মুল অভিযান। নিহত হন শত শত ইসলামপন্থী। সেই সময়ে শ্যুট টু কিলের সরাসরি অনুমোদন পায় পুলিশরা। শাহাবাগের সমাবেশ থেকে ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে ভয়াবহ হেটস্পিচ বা ঘৃনা ছাড়ানো হয়। প্রথম দিকে উদ্দেশ্য ছিল আইনকে ব্যবহার করে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের সর্বোচ্চ শাস্তি দেওয়া। এই লক্ষ্যে যেহেতু দেশবাসীর মনোভাব সম্পূর্ন ভিন্ন রকমের ছিল, কাজেই সরকার শাহাবাগীদের দ্বারা জনমত তৈরি করার চেস্টা করছিল। শহীদ কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন সাজাকেও আন্দোলনের উছিলায় পরিবর্তন করে ফাঁসীর রায় দেওয়া হয়েছিল। ঠিক এইখানে প্রমান হয়, সুষ্ঠু বিচার তো দূর কি বাত, সহজ বাংলায় খুনের উছিলা তৈরিই ছিল শাহাবাগীদের আন্দোলনের উৎস। খুনের এই নজিরবিহীন অদম্য বাসনা বিশুদ্ধ লাশতান্ত্রিক ক্ষমতারই চিহ্ন। এখানে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে সে সময়ে ভারতও ৭১ এর মতোই শাহাবাগকে প্রকাশ্য সমর্থন দেয়। ভারতীয় পত্র পত্রিকা, বুদ্ধিজীবি, শিল্পী শাহাবাগকে সমর্থন দিয়ে যায়। বিখ্যাত গায়ক সুমন শাহাবাগের সমর্থনে গান রচনা করেন।

যুদ্ধপরাধ বা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সবার কাছে গ্রহনযোগ্য বিচারের ব্যবস্থা না করে, আদালত-বিচারকদের সরাসরি নিয়ন্ত্রন করা হয় শাহাবাগীদের পক্ষ থেকে। আদালতের বিচারকদের স্কাইপি কেলেঙ্কারী ফাঁস হয়ে পরে। প্রধান বিচারপতিকে যখন দেশান্তরী করা হয়, তখন তাঁর দেওয়া বক্তব্যেও একই বিষয় লক্ষ্য করা যায়। সেখানে দেখা যায় বিচারক সবিস্তারে বলছেন উনার কিভাবে চাপ প্রয়োগ করা হয়েছিল। মিথ্যা সাক্ষ্য তো আছেই, এমনকি আসামীপক্ষের সাক্ষীকেও গায়েব করে ফেলা হয়। বিচারব্যবস্থার উপর লাশতান্ত্রিক ক্ষমতা কার্যকর হয়েছিল যুদ্ধাপরাধের অভিযুক্তকে বৈচারিক উপায়ে হত্যার জন্যে। শুধু ইসলামপন্থিদের লাশ ফেলার জন্যে হন্নে হওয়া সরকার সাক্ষ্য আইন পর্যন্ত পরিবর্তন করে ফেলে, পত্র পত্রিকার রিপোর্টের ভিত্তিতে ফাঁসীর রায় বের করে আনার সুবিধার জন্যে। এম্বেম্বে অনেক বারই টেনেছেন ২য় বিশ্বযুদ্ধের কথা। নাজ্জি বা হিটলারি লাশতান্ত্রিক নীতি ছিল ফাইনাল সল্যুশন বা সার্বিক সমাধান, যার ভিত্তিতে দলে দলে ইহুদীদের হত্যা করা হয়েছিল। শাহাবাগীদের যুদ্ধাপরাধিদের বিচারও আদতে হত্যার ভিতর দিয়ে সার্বিক মীমাংসা বা ফাইনাল সল্যুশনের নামান্তর। একই রকমের ক্যাঙ্গারু কোর্টের উদাহরন দেওয়া যাবে ইতিহাস থেকে অনেক। বিচার ব্যবস্থা পরিনত হয় ইসলামপন্থীদের বিরুদ্ধে ঘৃনার শেষ আনুষ্ঠানিক বেআইনি বা আইনবহির্ভূত আইনী পর্ব হিসাবে।      

যে কোন আইনের অন্যতন উছুল হলো Presumption of innocence বা অভিযোগ না প্রমান হওয়া পর্যন্ত অভিযুক্ত নিরপরাধ। পশ্চিমা ধাচের গনতান্ত্রিক রাস্ট্রগুলির নাগরিকদের সাংবিধানিক মৌলিক দিক হলো বিল অব রাইট বা চার্টার অব রাইট, যার মাধ্যমে নাগরিক ও রাস্ট্রের সম্পর্ক নির্ধারিত হয়ে থাকে। এটি এক ধরনের আইনী নিয়ন্ত্রন মূলক ক্ষমতার অংশ। একে ব্যক্তির নাগরিক অধিকারের সনদও বলা যেতে পারে। Presumption of innocence হলো এই সনদের মৌলিক ধারা। আদালতের প্রথম কাজই একে নিশ্চিত করা। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে শাহাবাগের ক্ষেত্রে আমরা এসব নজিরবিহীন অবিচারের অভিনব ঘটনা এই প্রথম দেখলাম। ক্যাঙ্গারু কোর্টের উদাহরন আরো আছে পৃথিবীতে। কম্বোডিয়ার স্বৈর শাসক পলপটকে অনুপস্থিতিতে মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়। তদন্তে যখন দেখা গেল যে, বিচার শুরু হওয়ার আগেই রায়ের দলিল লিখা শেষ হয়ে গিয়েছিল, তখন আন্তর্জাতিক আইনের সাথে অসংগতি আছে এই যুক্তিতে জাতিসংঘ এই রায়ের ন্যায্যতা প্রদান থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নিয়ে একে অবৈধ ঘোষনা করে।[xii] শাহাবাগী ক্যাঙ্গারু কোর্টের ক্ষেত্রে আমরা দেখি যে, লাশতান্ত্রিক ক্ষমতাধর রাষ্ট্র শক্তি বিচারকে যখন যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে ব্যবহার করতে সক্ষম। তারা অভিযুক্ত ইসলামপন্থীদের লাশ ফেলার বাসনাতেই একে গড়ে তুলেছে। এই অভিযুক্তরা এমনই যে তাদের ক্ষেত্রে সাক্ষ্য-সাক্ষী সংক্রান্ত আইনের সমস্ত উসুল একেবারে উল্টিয়ে দেওয়া যায়। স্বাধীন বিচারক পরিনত হয় লাশতন্ত্রের আজ্ঞাবহ দাসে। অপরাধী ব্যক্তির জন্মগত পরিচয় পর্যন্ত লাশতান্ত্রিক ক্ষমতা দখল করে নেয়। তার জন্মগত নাম বা পরিচয়ে পর্যন্ত সে আর পরিচিত হতে পারে না। শহীদ আব্দুল কাদের মোল্লা এবং শহীদ দেলোয়ার হোসেন সাঈদীর ক্ষেত্রে এই মিস আইডেন্টটি বা ভুল পরিচয় সনাক্তকরনের কথা উঠে। যুদ্ধাপরাধী ইসলামিস্টরা যেন অপরাধ ছাড়াই আগাম-অভিযুক্ত। এমনকি পরবর্তীতে সকল জামায়াত-শিবির কর্মীই এই আদালতে অভিযুক্ত একেকজন যুদ্ধাপরাধী হয়ে লাশতান্ত্রিক চিরস্থায়ী বর্নবাদী ঘৃনার শিকারে পরিনত হয়। এভাবে অভিযোগের ভিত্তি ছাড়াই অপরাধী পরিচয়ে আগাম পরিচিত হতে থাকার ঘটনাকে এম্বেম্বে বলেছেন A-priori suspect (আগাম চিরস্থায়ী অভিযুক্ত, যিনি অপরাধ অভিযোগ ছাড়াই অপরাধী বনে যেতে পারেন). ‘Where does justice stop and where does vengeance begin when laws, decrees, searches, checks, special tribunals, and other emergency measures aim above all to generate a category of a priori suspects, yielding a state of suspicion that (in the case of Islam) is only intensified by the injunction to adjure.”[xiii]   

আমরা দেখলাম যে, বায়োপাওয়ার যেখানে শরীরের উপর নিয়ন্ত্রন ও ব্যবস্থাপনামূলক ক্ষমতা কায়েম করতে চায়, লাশতন্ত্র সেখানে লাশ ফেলানোর ক্ষমতা প্রয়োগ করে। লাশতান্ত্রিক ক্ষমতার  সব চাইতে নিকৃস্টতম উদাহরন হলো লাশ অবমাননা। শাপলা চত্বরের গনহত্যায় শহীদ আলেমদের লাশ গুম করে দেওয়া। আল জাজিরার প্রতিবেদনে দেখানো হয়, হত্যাকান্ডের রাতে গোপনে অনেকগুলি দাঁড়ি যুক্ত লাশ একসাথে আজিমপুরে কবর দেওয়া হয়। শহীদ সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কবর ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের ভাঙচুরের শিকার হয়। এমনকি এমনটাও শোনা যায় যে, সেই কবরে প্রস্রাব করে এক ছাত্রলীগ নেতা। হত্যার পরেও ঘৃনা প্রকাশের এইসব নজির অবর্ননীয়। নেক্রোফিলিয়া বা লাশানুরাগ রোগাক্রান্ত মানুষ লাশের সাথে যৌন সম্ভোগ করা ছাড়া স্বাভাবিক ভাবে যৌন ক্রিয়ায় অংশ নিতে পারে না, অথবা জীবিত মানুষের সাথে সহবাসের সময় যৌন সঙ্গীকে লাশ হিসাবে কল্পনা না করলে উত্তেজিত হতে পারে না। লাশতান্ত্রিক ক্ষমতার ফলাফল হিসাবে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ভয়ঙ্কর ঘটনাগুলি পর্যবেক্ষন করলে বুঝতে পারি শাহাবাগ নেক্রোফিলিক ইরোটিসিজম বা লাশতান্ত্রিক বিকারগ্রস্থতার জন্ম দিয়েছে। প্রচন্ডতম ধর্ষকামী মানুষ বা কোন স্যাডিস্ট ধর্ষনের পরে চক্ষুলজ্জা বা ধরা পরে যাওয়ার ভয়ে ধর্ষনের ভিকটিমকে হত্যা করে। কখনো সেই লাশ গুম করে ফেলে। শাহাবাগও এমন অসংখ্য গুম খুনের জন্ম দিয়েছে। নেক্রোফিলিক ইরোটিক বিকারগ্রস্থ শাহাবাগীরা ২০১৩ তে বারবার হেফাজতকে জামায়াত-শিবিরের তৈরি বলে মিথ্যা প্রচার করেছে। সাধারন ইতিহাস যে জানে, সেও বুঝে কওমী ধারা এবং জামায়াত শিবির এক নয়। ইসলাম্পন্থীদের সকল ধারাকে খতমের টার্গেট করে। এভাবে শাহাবাগীরা এই ঘৃনা ছড়িয়ে ৫ই মের হত্যাযজ্ঞের শক্ত পটভূমি তৈরি করে। বিকারগ্রস্থ শাহাবাগীরা দেশকে একটা চূড়ান্ত সন্দেহবাতিকগ্রস্থ রাস্ট্রে (absolute paranoid state) পরিনত করে ফেলে। কারো কাছে ইসলামী বই পেলে জিহাদী বই সন্দেহে আটক, কোথাও কয়েকজন দাওয়াতি কাজে মিলিত হলে রাস্ট্রের বিরুদ্ধে নাশকতার ষড়যন্ত্র, অভিযুক্তকে না পেলে তার সন্তান, ভাই-বোন-পিতা মাতাকে আটক – এভাবে অবর্ননীয় জুলুম নির্যাতন নেমে আসে ইসলাম পবন্দ অনেক সাধারন মুসলিম নাগরিকদের উপর। এইসবকিছু আসলে রাষ্ট্র করতে পারছে কারন তারা মনে করেছে জামায়াত-শিবির-আলেমদের মৃত্যুর সিদ্ধান্ত নিবার অথবা তারা বেঁচে থাকবে নাকি মারা যাবে এই সিদ্ধান্তের এখতিয়ার রাস্ট্রের অথবা শাহাবাগীদের হাতের মুঠোয়।  

যাকে আমরা সন্দেহবাতিকগ্রস্থ রাষ্ট্র বললাম, এম্বেম্বে তাকেই সিকুরিটি স্টেট বলে অভিহিত করেন, যা কিনা দেশজুড়ে এক সার্বিক নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করার উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠে। কোন শত্রু যে রাস্ট্রকে নিরাপত্তাহীন করে ফেলছে, শুধু তা না। বরং নিরাপত্তাহীনতা তৈরি করতে পারে এমন শত্রুর কল্পনা করে, তাকে তিল থেকে তাল বানিয়ে নিরাপত্তা রক্ষার নামে লাশতন্ত্র কায়েম করে দেশকে স্থায়ীভাবে অনিরাপদ রাষ্ট্র বানিয়ে ফেলা হয়। অর্থাৎ এম্বেম্বের বিশ্লেষনে পরিস্কার হয়ে যায় মূলত লাশতন্ত্রই নিরাপত্তাহীনতার শর্ত তৈরি করে, কথিত শত্রুরা মোটেও এই জন্যে দায়ী না।  ইসলামপন্থী শত্রুর জান কবজ তো বটেই, তার তৈরি হাসপাতাল, স্কুল, ব্যাংক পর্যন্ত রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা সংস্থা ব্যবহার করে দখল করে ফেলা হয়। শুধু খুন বা গুম না অস্তিত্ত্বের শত্রু ইসলামপন্থীদের ভাতে-পানিতে খতমের আয়োজন করা হয়। লাশতান্ত্রিক ক্ষমতার কর্তা সার্বভৌম সত্ত্বা আকারে নিজেকে কল্পনা করে। লাশতান্ত্রিকতায় যেই সার্বভৌম ক্ষমতাকে কার্যকর হতে দেখা যায়, তা এক বিশেষ ধরনের সার্বভৌম ক্ষমতা। সার্বভৌম ক্ষমতা নিয়ে কাজ করে সুখ্যাত হয়েছিলেন জর্মান ক্ষমতা বিশেষজ্ঞ কার্ল স্মীট। স্মীট পশ্চিমা সংবিধান এবং আইনের ঠিকুজী-ইতিহাস বিশ্লেষন করে স্পস্ট করে দেখিয়েছেন যে, সার্বভৌম ক্ষমতা আইনেরও উপরে। আইন কখন প্রযোজ্য হবে আর কখন আইনকে স্থগিত রাখা যাবে অথবা আইনকে হাতে উঠিয়ে নিতে হবে সেটা নির্ধারন করে সার্বভৌম ক্ষমতা। ফুকো ক্ষমতার কিছু রুপের বিশ্লেষনে যখন বায়োপাওয়ার বা নফসীয় ক্ষমতার কথা বললেন, তখন দেখালেন আধুনিক কালে এমন ক্ষমতা দেখা যায় যা জীবন বা প্রানের ব্যবস্থাপনার তাগিদে প্রানের অধিকারী মানুষের উপর নানা স্তরে ও পদ্ধতিতে প্রয়োগ করা হয়। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি যেমন নফসীয় ক্ষমতার উদাহরন, কোন দেশ কোন বছরে কোন নির্দিস্ট কোন ওষুধ কি পরিমানে আমদানী করবে, সেই সিদ্ধান্ত নেওয়াও বায়োপাওয়ারের কাজ। নাগরিকদের কোন অংশ জাতীয় ওষুধ নীতির সব চাইতে বেশি সুবিধা পাবে, আর কাদের কথা নীতিতে প্রাধান্য পাবে না, সেটাও বায়োপাওয়ার নির্ধারন করবে। ইটালীয় বিখ্যাত দার্শনিক জর্জিও আগামবেন স্মীটের সার্বভৌমত্ব ক্ষমতা এবং ফুকোর বায়োপাওয়ার আরো গভীরে বিচার করেন। উনি লক্ষ্য করেছেন যে, সার্বভৌম ক্ষমতা অবশ্যই আইনকে সংজ্ঞায়ন করতে পারে, আইনের সীমা নির্ধারন করে কখন আইন বলবৎ থাকতে পারবে না, সেই জরুরী অবস্থার সিদ্ধান্তও নিতে পারে। উপর্যুপরি সার্বভৌম ক্ষমতা মানুষের জীবন ও মরনের বিষয়েও সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। স্বাস্থ্য বা খাদ্য ইত্যাদি আরো অনেক কিছু তথা জীবন ব্যবস্থাপনার জন্যে নানা রকম প্রক্রিয়া বায়োপাওয়ার নাগরিকদের উপর প্রয়োগ করে। তবে কখনো বায়োপাওয়ারের জীবন সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া মরনের বা মৃত্যুর সিদ্ধান্তে পরিনত হয়। বায়োপাওয়ারের এই পর্যায়কে আগাম্বেন মরনের ক্ষমতা বা Thanatopolitics বলে অভিহিত করেছেন।[xiv] এই মরনের সিদ্ধান্ত নিবার দিকটিও সার্বভৌম ক্ষমতার প্রকাশ। লাশতান্ত্রিক ক্ষমতাও সার্বভৌমত্বের বিকারগ্রস্থ প্রকাশ, মরনক্ষমতার মতোই। আগাম্বেন দেখিয়েছেন, সার্বভৌম ক্ষমতা প্রথমে মানুষের শরীর-মন থেকে মনুষ্যত্ব-অধিকার-সামাজিকতা-রাজনৈতিকতা পোশাকের মতো খুলে ফেলে তাকে নিছক নগ্ন-মানুষে (bare life) এ পরিনত করে। এম্বেম্বের মতে, ফুকোর নফসীয় ক্ষমতা যেখানে জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করে নিজের ক্ষমতা দেখায়, সেখানে লাশতান্ত্রিক ক্ষমতা এমন এক সার্বভৌম ক্ষমতা যা কিনা জীবনকে মৃত্যুর ক্ষমতা দিয়ে শাসন করে। শাহাবাগ এসব ক্ষমতার বিভৎস নজির হিসাবে ইতিহাসে ঠাঁই পেল।                           

৭।  

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই ঘৃনা তৈরির প্রক্রিয়াকে ধরতে গিয়ে আমরা খুব একটা কৌতুহল উদ্দীপক বিষয়কে খুঁজে পাব। প্রগতিশীলরা যখন ইতিহাসের বয়ান তৈরি করে তখন ক্ষমতাসীন বিভিন্ন গোষ্ঠী, শ্রেনীর ভিতরে সক্রিয় ইসলামপন্থা বিদ্বেষ- যাকে এম্বেম্বে সূক্ষ্ম বর্নবাদ বা Nanoracism বলেছেন, তা সম্পূর্ন উপেক্ষা করে, দেখেও না দেখার ভান করে, বালিতে মুখ গুঁজে থাকে, মুখ অন্য দিকে সড়িয়ে নেয়, অথবা চটকদারী শব্দরাজি ব্যবহার করে ইসলামী রাজনৈতিকতার মর্ম থেকে আলোচনা সড়ায়ে নেয় অথবা উপনিবেশী জ্ঞানীয় প্যারাডাইমের নিরিখে ভূল ব্যাখ্যা করে।  এমন সজ্ঞানে অজ্ঞান হয়ে থাকাকে উত্তর উপনিবেশী তাত্ত্বিক ডিকন্সট্রাকশনিস্ট  গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক[xv] এই প্রক্রিয়াকে তথাকথিত পশ্চিম ঘেঁষা সেক্যুলার সাম্যবাদী বুদ্ধিজীবিদের Sanctioned Ignorance বলে অভিহিত করেছেন।  আপনারা দেখবেন, প্রগতিশীলরা বামেরা যখন ৪৭ এর ঐতিহাসিক বয়ান খাড়া করে, তখন হয় তাকে সাম্প্রদায়িক, জাতিবাদি, পরিচয়বাদী ইত্যাদি বলে খারিজ করে, না হয় সেই আজাদীর আত্মাগত মর্ম মুসলিম আত্ম-সত্ত্বা বা Ontology কে সম্পূর্ন উপেক্ষা করে তাকে মার্কসীয় শ্রেনী দ্বন্দ্ব নির্নয়ের পদ্ধতি অনুসারে নিছক জমিদার-প্রজার দ্বন্দ্বে পর্যবসিত করে। তার অর্থ রাজনৈতিক মুসলিমের আপন সত্ত্বার বয়ানে তাকে পরিচিত করা যাবে না, কারন তা কোন প্রগতিশীলের কাছে গ্রহনযোগ্য না, বোধগম্য না। অন্যভাবে বললে আপন পরিচয়ে পরিচিতি হলে তাকে আর নিয়ন্ত্রন কঠিন হবে ডিসিপ্লিনারী বা নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতা দ্বারা। আর নিয়ন্ত্রনের বড় উপায় হলো তাকে ক্ষমতাধরের ভাষায় নামকরন, শ্রেনীকরন, বর্গকরনের ভিতর দিয়ে শত্রুর আপন বিশেষ স্বত্তা (Dasein)কে ভেঙ্গে দিয়ে, উইনিভার্সালিজমের মেটাফিজিক্সে তাকে ভরে ফেলা। এভাবেই ৪৭ এর মুসলিম চৈতন্যের আজাদী পর্যবসিত হয় নিছক জমিদার-প্রজার গৌন দ্বন্দ্বে, যেখানে মুসলিম চৈতন্যেই জমিদার বিরোধিতার বিশেষ কারন হিসাবে অগ্রগামী। ইসলামী চৈতন্যকে দেখেও না দেখে গুড সেক্যুলারেরা যেই ভান ধরে, তা গায়ত্রী বর্নিত Sanctioned Ignorance এর উদাহরন। ডিসিপ্লিনারী ক্ষমতার অধিকারী গুড সেক্যুলারেরা এভাবে সজ্ঞানে অজ্ঞান অবস্থায় লাশতন্ত্রের জন্যে সহায়ক বয়ান তৈরি করে। লাশতন্ত্র যখন ইসলামীদের প্রান হরন করে লাশ গুম করে, সজ্ঞান অজ্ঞানীরা সেভাবে ইসলামীদের অস্তিত্ত্বের মর্মকে নিজেদের অজ্ঞানতার ভিতর লুকিয়ে ফেলে। এমন কি গুড সেক্যুলারদের কেউ কেউ ২০১৩ সালে শাহাবাগের বিরুদ্ধে হেফাজতের পক্ষে সক্রিয় থেকেও ইসলামপন্থা বিনাশী সাম্য-মানবিক মর্যাদা বা ধর্মনিরপেক্ষতার ফেরী করেন।    ব্যাড সেক্যুলারেরা অপরদিকে লাশতান্ত্রিক খতম অভিযানে সরাসরি উপস্থিত থাকে। শাহাবাগী লাশতান্ত্রিকদের ভিতর উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বুদ্ধিজীবি, লেখক, সাহিত্যিকদের দেখি যারা এই মহল থেকে সড়ে দাঁড়িয়েছেন কিন্তু শাহাবাগ বান্ধব স্পেস তৈরি করছেন সমাজের নানা স্থানে। ইনারা এখনো লাশতন্ত্র সহায়ক বয়ান নির্মানে ব্যস্ত, যার মূল কথাই ইসলামপন্থা ঠেকাও। মিশরেও ঠিক একই পদ্ধতিতে বামপন্থী সেক্যুলার সাম্যবাদীরা সিসির মতো বিভৎস লাশতন্ত্র কায়েমে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছেন। গুড এবং ব্যাড সেক্যুলার সমাজ এভাবে বাইনারী চয়েসের মুখে ইসলামীদের ফেলে দেয়। কাজেই হয় তাকে ডিসিপ্লিনারী ক্ষমতা দ্বারা নিয়ন্ত্রন করতে হবে অথবা লাশতান্ত্রিক ক্ষমতায় নির্মূল হতে হবে। 

তবে গুড সেক্যুলারদের একটা অংশ অধিকার সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে সক্রিয়। ইনারা নেক্রোপলিটিকাল ভায়োলেন্সকে বায়োপাওয়ার বা ডিসিপ্লিনারী ক্ষমতায় পরিবর্তন করতে চান। এতে সার্বভৌম ক্ষমতার গুনগত দিক পরিবর্তিত না হলেও, পরিমান ও তীব্রতা কমতে পারে। ইনাদেরকেও ইসলামী ঐতিহ্য ও রাজনৈতিকতার মোকাবেলায় সজ্ঞানে অজ্ঞান হয়ে থাকার আরোপিত অজ্ঞানতার পথ পরিহার করতে হবে। একটা গৃহযুদ্ধের পরে জাতীয় মীমাংসার নানা প্রক্রিয়ায় দেশের সমাজে যুদ্ধ চলাকালীন তীব্র মেরুকরনের অবসান ঘটানো হয়। রাস্ট্রের দিক থেকেও এই প্রক্রিয়া গুরুত্ত্বপূর্ন কারন বিদ্যমান সমাজকে একটি এক রৈখিক রাস্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণমূলক ক্ষমতার আওতায় শাসন করা রাষ্ট্রীয় সংহতি রক্ষার জন্যে খুব প্রয়োজন। এতে বিবাদমান সামাজিক ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীগুলি আন্তঃস্বীকৃতির ভিতর দিয়ে পরস্পরের ভিতর মেল বন্ধন তৈরি করে। দ্বন্দ্ব সংঘাতের প্রেক্ষাপট যদি রাষ্ট্র হয়, তবে রাস্ট্রের স্বাভাবিক পরিস্থিতি, নিরাপত্তা ও টিকে থাকার স্বার্থেই একটি জাতীয় মীমাংসামূলক সুবন্দোবস্তের আওতায় পারস্পরিক স্বীকৃতির ভিতর দিয়ে নতুন রাজনৈতিক সমাজের নির্মান সম্ভব। দুঃখের বিষয় এরকম একটা সুযোগ প্রেসিডেন্ট জিয়ার শাসনামলের অবসানের ভিতর দিয়ে আমরা হারিয়েছি। তখন ইসলামী রাজনৈতিকতাকে সাংবিধানিক ভাবে স্বীকার করে জাতীয় সুবন্দোবস্ত, মীমাংসা বা ফয়সালার একটা পর্ব শুরু হয়েছিল। খেয়াল করে দেখা যায়, নেক্রোপলিটিকাল ভায়োলেন্স দিয়ে সেই প্রক্রিয়া সম্পূর্ন নির্মূল করা হয়েছে। শাহাবাগের পরে আমাদের সবার সামনে সকল বাংলাদেশীদের এই পথ এখনো খোলা আছে।

শেষকথাঃ

ইসলামীদের কথা দিয়েই শেষ করবো। শাহাবাগের চূড়ান্ত প্রতিশোধ নিয়েছেন সকল শহীদেরা। কিন্তু মঞ্চের সেই লাশসহ সকল শহীদের লাশ তাকিয়ে আছে জীবিতদের দিকে। আমরা যত ধরনের ক্ষমতার রুপই আলাপ করি না কেন, এসব কিছুর লক্ষ্য মুসলিম আত্মস্বত্ত্বা। মুসলিমদের লাশ ফেলানো যাবে কিন্তু তাদের আত্মসত্তাকে কব্জা করার উপায় হলো মুসলিম আত্ম চৈতন্যে সংশয় সন্দেহ জাগানো। এই লক্ষ্যে ব্যাড বা গুড যাই বলি না কেন সকল সেক্যুলারেরা মনে প্রানে চায় আজ্ঞাবহ দাস তৈরি করতে। এরাই হীনমন্য মুসলিম। সেই দাস বা হীনমন্য মুসলিমের চেহারা সুরতও যেন হয় আজ্ঞাবানের মতো। তার পোষাক, সংস্কৃতি শুধু না, তার রাজনৈতিকতাও যেন হয় মনিবের মন মতো। জেনে বুঝে সাম্য-মানবিক মর্যাদা, সেক্যুলারিজম-রিপাব্লিকানিজম ইত্যাদি বুলি, গালগপ্পো আর যেই কিচ্ছাই সেক্যুলারেরা সামনে আনে, তাই চেটে উঠানোর মতো হীনমন্যতাও দেখা যায় ইসলামী সমাজে। ইবনে খলদুনের ভাষায়, ‘ The vanquished always want to  imitate the victor in his distinctive characteristics, his dress, his occupation, and all his other conditions and customs. The reason for this is that the soul always sees perfection in the person who is superior to it and to whom it is subservience. It considers him perfect, either it is impressed by the respect it has for him, or because it erroneously assumes its own subservience to him is not due to the nature of defeat but to the perfection of victor. লাশতান্ত্রিক ক্ষমতা এতই নৃশংস এবং মর্মভেদী যে, পরাজিত যে, তাকে পরাজয়ের কারন অনুসন্ধান না বরং জয়ীকেই পরিপূর্ন সার্বভৌম স্বত্বা আকারে দেখতে হয়, নত হতে হয়, সমর্পন করতে হয়। এই কারনেই জামায়াত শিবির অথবা ইসলামপন্থী দের ক্ষমা চাইতে বলা হয়। শহীদেরা ক্ষমা চান নাই। মঞ্চের সেই লাশ আমাদের কাছে যেন জানতে চাইলো- তোমরা কি ক্ষমা চাবা?            

    

   

[i] হেইদগর, মার্টিন, বিয়িং এন্ড টাইমের

[ii] Sayyid, Salman, Recalling the caliphate, p. 33

[iii] দৈনিক পাকিস্তান, ৪ জুন, ১৯৭১

[iv] দৈনিক ইত্তেফাক, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৩

[v] Mbembe, Achille, Necropolitics, p.66

[vi] Blitz, Brad K.,, Lynch, Maureen (Maureen Jessica),। Statelessness and citizenship : a comparative study on the benefits of nationality। Cheltenham, UK। পৃষ্ঠা ১১৭।

[vii] Mbembe, Achille, Necropolitics, p.43

[viii] ROUTLEDGE HANDBOOK OF PSYCHOANALYTIC POLITICAL THEORY, Edited by Yannis Stavrakakis

[ix] Mbembe, Achille, Necropolitics, p. 43

[x] Lbid, p.48

[xi] Seguin, Charles; Rigby, David (2019). "National Crimes: A New National Data Set of Lynchings in the United States,
   1883 to 1941"

[xii] Chandler, David (2008). "Cambodia deals with its past: Collective memory, demonisation, and induced amnesia". Totalitarian Movements and Political Religions. 9 (2–3): 355–369.

[xiii]  Mbembe, Achille, Necropolitics, p.33

[xiv] Agamben, G. (1998) Homo Sacer: Sovereign Power and Bare Life, p.122

[xv] Spivak, Gayatri Chakravorty, A Critic of Postcolonial Reason, p.2