‘শাহবাগ ছিল ইসলামের রাজনৈতিকতাকে নির্মূল করবার প্রয়াস যার মুল টার্গেট ছিল জামাতে ইসলামী’

Mufti Harun Izhar

শাপলার দশ বছর উপলক্ষেচিরায়ত-মাইলস্টোনের যৌথউদ্যোগেএই সাক্ষাৎকারটি নেয়া হয়েছে—হেফাজতের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব মুফতি হারুন ইযহার হাফিজাহুল্লাহু থেকে। চিন্তা,দর্শন,রাজনীতি ও শাপলা-শাহবাগের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোচনা উঠে এসেছে এতে। সাক্ষাৎকারের প্রশ্ন তৈরি করেছেন—মাইলস্টোন এবং চিরায়ত সম্পাদনা বিভাগ। সরাসরি সাক্ষাৎকারগ্রহণ এবং অনুলিখন করেছেন—চিরায়ত‘র চট্রগ্রাম প্রতিনিধি নাহিন শিকদার।

●একাত্তর-উত্তর বাংলাদেশে শাহবাগ আন্দোলন এবং এর প্রতিরোধস্বরূপ শাপলার গণজমায়েত নিঃসন্দেহে ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ। এই সন্ধিক্ষণের অংশআপনিও ।শাহবাগ আন্দোলনের নেতৃত্ব উলামায়ে কেরামের জামাত-বিরোধিতাকে সামনে এনে উলামায়ে কেরামকে শাহবাগে আসবার আহবান জানিয়েছিল৷ শাহবাগ ইসলামের বিরুদ্ধে না, এটা প্রমাণের জন্য শাহবাগে কুরআন পাঠ হয়েছে৷ এক বিশেষ গোষ্ঠীর আলেমও উপস্থিত ছিলেন ৷শাহবাগ আন্দোলনেরএই চিত্রকে আপনি কিভাবে মূল্যায়ন করবেন? শাহবাগ কি সকলের হয়ে উঠতে পেরেছিল নাকি গুটিকয়েক মানুষের ইসলাম ও ইসলামপন্থার নির্মূলের বাসনার প্রকাশ ছিলো মাত্র?

●●শাহবাগ আন্দোলনের মূল্যায়নে তিনটি বিষয়কে সামনে রাখতে হবে:

ক. ঐতিহাসিক

খ. ভূ-রাজনৈতিক

গ. অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক

যদি আমরা ঐতিহাসিক বিচারে বলি; তাহলে এইটা খুবই পরিষ্কার যে, এটি ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে ইসলামবিরোধী এজেন্ডার ধারাবাহিকতা। ঐতিহাসিকভাবে শাহবাগআন্দোলনের প্রাথমিক প্রেক্ষাপট যতটা রাজনৈতিক ছিল তারচেয়ে অধিক ছিল সাংস্কৃতিক ও সামাজিক। আর যেকোনো রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য প্রথমেই প্রয়োজন একটা সামাজিক আন্দোলন গড়েতোলা। যার মূল বুনিয়াদ ও চরিত্রটা হয়ে থাকে সাংস্কৃতিক। তো আমি মনে করি; শাহবাগ আন্দোলনের এই ঐতিহাসিক কালচারাল ও সামাজিক পটভূমিটির মূল্যায়ন সর্বাগ্রে হাজির রাখা যায়। ঘাতক-দালালনির্মূল কমিটির সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং তার সৃষ্টির পটভূমিকে বোঝার মধ্যেইপরবর্তী শাহবাগ আন্দোলনের সঠিক মূল্যায়ন নিহিত।

এরপর আসা যাক ভূ-রাজনৈতিক বিষয়ে। এখানে চরমভাবে প্রাসঙ্গিক হলো ভারত। ঘাদানিক থেকে শাহবাগযে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক আন্দোলন, তাকে আগাগোড়াই পেট্রোনাইজ করেছে ভারতীয় শাসক গোষ্ঠী। কেননা বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইসলামপন্থাকে ভারত বরাবরই তার জন্য সিকিউরিটি-থ্রেট মনে করে ভূল করে। বাংলাদেশীরা ভারত বিদ্বেষী নয়। বরং ভারত যখন আধিপত্যবাদী আচরন করে, সেই আধিপত্যবাদী আচরন বিরোধী। বাংলাদেশের মানুষের তৃতীয়যে বিষয়টি বলা বাহুল্য, তা হলো দেশীয় অভ্যন্তরীণ রাজনীতির ব্যাপারটি। আর তা হলো বাংলাদেশজামায়াতে ইসলামীর সাথে আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক সংঘাত। বিশেষত চারদলীয় জোটের

সুবাদে‘জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ’যখন আংশিকভাবে একটি ক্ষমতাসীন দল, তখন আওয়ামী লীগ প্রধানবিরোধীদল ছিল। স্বাভাবিকভাবেই গণতান্ত্রিক সিস্টেমে বিরোধীদল সরকারি দল কর্তৃক কিছুটা নিগ্রহের শিকার হয়ে থাকে। যদিও চারদলীয় জোট আমলে বিএনপিই ক্ষমতার মূল কান্ডারী ছিল। তবুও শরিক দল হিশেবে জামায়াতকে অনেক কিছুর দায়ভার নিতে হয়েছে। চারদলীয় জোট সরকারেরআমলে আওয়ামী লীগের মধ্যে চরম জামায়াত বিদ্বেষের দানা বেঁধে ওঠে।

আরএমনিভাবে শাহবাগ আন্দোলনের ঐতিহাসিক—আদর্শিক-সাংস্কৃতিক-সামাজিক আন্দোলনটি প্রতিবেশীরাষ্ট্রের ভূ-রাজনীতির সর্বাত্মক সাপোর্ট নিয়ে জামায়াত বনাম আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক বিরোধের সুযোগে তার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌঁছে যেতে সক্ষম হয়।

উক্ত বাস্তবতার আলোকে এই কথা অত্যন্ত পরিষ্কার যে, যুদ্ধাপরাদের বিচার এই শিরোনামটি কোনোভাবেইএকটি মানবিক এজেন্ডা নয়। বরং আদর্শিক ও রাজনৈতিক এজেন্ডা। প্রশ্ন হলো জামায়াত একক ভাবে কেন এই এজেন্ডার টার্গেটে পরিণত হয়? যেখানে জামায়াতে ইসলামী ছাড়াও আরও অনেকেই একাত্তরসালে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী ছিলেন। বিশেষত উলামা তথা ইসলামপন্থীদের একটি বড় অংশ। এটি অন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন। যার সোজাসাপটা উত্তর হলো অন্যান্য ইসলামপন্থী দের তুলনায় জামায়াতের ব্যাপক রাজনৈতিক সাফল্য। দৃশ্যমান অগ্রগামী পলিটিক্যাল ইসলামকে নির্মূলকরাই ছিল দেশীয় আঞ্চলিক সেক্যুলার শক্তির মূল টার্গেট। এই জায়গায় জামায়াতে ইসলামী ছাড়া যারাই ইসলামের রাজনৈতিক শক্তি হিশেবে আবির্ভূত হতো, তারাই এই সেক্যুলার অক্ষশক্তির টার্গেটে পরিণত হতো।

দেশের আপামর তাওহিদি জনতা শাহবাগ আন্দোলনকে একটি ইসলামবিরোধী চক্রান্ত হিশেবে মনে করে থাকে। এটাই সকল ইসলামপন্থীদের সাধারণ সেন্টিমেন্ট। আর এই সেন্টিমেন্টকে বিভক্ত করার জন্যতারা কিছু ঠুনকো কৌশল গ্রহণ করে। সেই কৌশলের অংশ হিশেবে শাহবাগ আন্দোলন প্রথম দিকে ইসলামি রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবী তুললেও পরক্ষণেই তারা স্লোগান পরিবর্তন করে কেবল জামায়াত নিষিদ্ধের দাবীকে রিপ্লেস করে। কিছু আলেমকে গণজাগরণ মঞ্চে নেয়া হয়। সেখানে কুরআন পাঠ করা হয়, আজান ও নামাজের বিরতি দেওয়া হয়—এই সবই ছিল তাদের ঠুনকো কৌশল। যা কোনো ভাবেই তাদের ইসলামবিরোধী অবয়বকে কলংকমুক্ত করতে কোনোরকম কাজে দেয়নি। সুতরাং শাহবাগ আন্দোলন যেইভাবে নিজেকে মূলধারার একটি আন্দোলন হিশেবে জনমানুষের কাছে স্বাভাবিকবার্তা দিতে চেয়েছিল তা সফল হয়নি। এটি বরাবরই ইসলামবিদ্বেষী একটি চক্র হিশেবে—উপরন্তুভারতীয় মদদপুষ্ট একটি সেক্যুলার এলিমেন্ট হিশেবে বৃহত্তর তাওহিদি জনতার কাছে ধিকৃত হয়েছে।

●শাহবাগ আন্দোলনের মুখপাত্র হিসাবে সর্বজন পত্রিকা বেশ মশহুর ছিল। সর্বজন পত্রিকায় অনেক লেখকই উলামায়ে দেওবন্দের আকাবির দের সামনে এনে সাথে জামায়াতে ইসলামীবা হযরত মাওলানা মাওদুদি রহি.এর সাথে যে ঐতিহাসিক, ধর্মতাত্ত্বিকবিরোধ তা তুলে ধরেন। তাসনিম আলম তার‘ইসলাম ও জামাতে ইসলামি: প্রেক্ষিত শাহবাগ আন্দোলন’ প্রবন্ধে মাওলানা ওবায়দুল্লাহ ফারুক হাফি.এর‘ইসলাম ও মাওদুদির সংঘাত’বইয়ের দোহাই দিয়ে বলেন জামায়াতে ইসলামীবা মাওদুদিকে উলামায়ে কেরাম ভ্রান্ত মনে করেন। শাহবাগপন্থী বুদ্ধিজীবী, লেখকরা বাংলাদেশের উলামায়ে কেরামকে আহবান জানায় এই ধর্মব্যবসায়ী জামাতের বিরুদ্ধে তারাও যেন শাহবাগে যোগ দেয়৷ শাহবাগপন্থী আরেক বুদ্ধিজীবী বিনায়ক সেনও উলামায়ে কেরাম কে ইসলামবিকৃতকারী জামাতের বিরুদ্ধে অবস্থান

নিতে আহবান জানায়৷এদের সাথে তাল মিলিয়েছেন হোসাইন আহমদ মাদানীপন্থীরা। শাহাবাগপন্থী বুদ্ধিজীবীরা আধুনিক ইসলামপন্থী জামায়াতকে এইভাবে নির্মূল করার জন্য সবাইকে শরিক করতে চায় কেন?

শাহাবাগের দুইটাদিক। ১.ক্ষমতার জায়গা থেকে ইসলামকে নির্মূল করা যা উপরে উল্লেখিত জামায়াত বিদ্বেষে ফুটে উঠে। ২.আরেক দিক হল সামাজিক-সাংস্কৃতিক জীবনের জায়গায় ইসলামকে নির্মূল করা, যা শাহাবাগীদের ইসলাম অবমাননার ভিতর ফুটে উঠে। এই যে দুইভাবে ইসলাম বিদ্বেষ, এর ভিতরঅলেমরা শুধু দ্বিতীয় প্রকার নিয়েই বেশি কথা বলেন। কিন্তু প্রথম বিষয়ে চুপ থাকেন। এই সংক্রান্ত আপনার মতামত যদি জানাতেন৷

●●জামায়াতে ইসলামী যুদ্ধাপরাধের বিচারের স্লোগানের আওতায় তিন সেক্যুলার শক্তির আগ্রাসনের শিকারহয়—

ক. ঘাদানিক তথা নব্য ঘাদানিকের (শাহবাগ আন্দোলন) সাংস্কৃতিকটার্গেট।

খ. ভারতের ভূ-রাজনৈতিক টার্গেট।

গ.ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক টার্গেট।

এইবিশাল শক্তির মোকাবেলায় জামায়াত একটি কৌশলগত বড় ভুল করে বসে। তারা আদর্শিক ও ভূ-রাজনৈতিকব্যাপারটিকে আমলে না নিয়ে এটাকে আওয়ামী লীগের নিছক রাজনৈতিক এজেন্ডা হিশেবে ধরে নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন আদায়ের জন্য সর্বাত্মক লবিং করে। তারা দেশের অভ্যন্তরীণ বিশালইসলামি শক্তিকে এই বার্তা দিতে সক্ষম হয়নি যে, নিছক রাজনৈতিক কারণে নয় বরং ধর্মীয় আদর্শিক  কারণে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের বিচার শিরোনামে একটি গভীর চক্রান্তের জাল নির্মাণকরা হয়। উলামায়ে কেরাম শাহবাগের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন জামায়াতে ইসলামের কোনো রকমের প্রচারণার কারণে নয়। তাদের সাথে উলামাদের কাঙ্ক্ষিত যোগাযোগ ছিল না। তবুও উলামায়ে কেরাম শাহবাগ বিরোধী হয়ে উঠেছিলেন পুরোটাই স্বপ্রণোদিতভাবে। খোদ শাহবাগের ইসলামবিদ্বেষী কন্টেন্টও ন্যারেটিভের কারণে। উলামায়ে কেরমের শাহবাগ-বিরোধিতায় জামায়াতের কোনো অবদান ছিল না।এইটা একটা তাদের বড় ব্যর্থতা।

এইসময়টাতে জামায়াতকে একঘরে করার জন্য শাহবাগ ও আওয়ামী সরকারের পক্ষ থেকে মওদুদীবাদের জিগির তোলাহয়। খুব স্বল্পসংখ্যক মাওলানা এই প্রবণতার শিকার হলেও শাহবাগী নাস্তিক্যবাদের কারণে মওদুদীবাদের বিষয়টি কোনো জামায়াত বিরোধী সেন্টিমেন্ট উলামাদের মধ্যে জাগ্রত করতেপারেনি।

আপনি বলেছেন শাহবাগের দুইটা দিক—১.ক্ষমতার জায়গা থেকে ইসলাম নির্মূল। ২. সামাজিক-সাংস্কৃতিকজায়গা থেকে ইসলাম নির্মূল। আমি আপনার সাথে একমত যে, দ্বিতীয় প্রশ্নে উলামায়ে কেরাম সোচ্চার হলেও প্রথম প্রশ্নে অর্থাৎ ইসলামকে রাজনৈতিকভাবে নির্মূল করার যে প্রয়াস এবংযার প্রধান টার্গেট ছিল জামায়াতে ইসলামী, এর প্রতিবাদে উলামাদের ভূমিকা সোচ্চার ছিলনা। নিজেদেরকে কথায় কথায় অরাজনৈতিক পরিচয় দেওয়ার ট্ন্ডেন্সি থেকে এমন অবস্থা তৈরি হয়েছে। অবশ্যই উলামায়ে কেরামের মূল শক্তি সামাজিক। রাজনৈতিক নয় এবং প্রচলিত রাজনীতি আগাগোড়া কলুষতা যুক্ত। কিন্তু

নিজেদের অরাজনৈতিক পরিচয় বারংবার উচ্চারণের পেছনে একটা ফেয়ার কমপ্লেক্স কাজ করছিল বলে আমার মনে হয়। মানে নিজেদেরকে নিরাপদ রাখার একটা মানসিকতাযেনো এখানে সুপ্তভাবে বিদ্যমান। অথচ দেশীয় আঞ্চলিক সেক্যুলার শত্রুরা যে অরাজনৈতিক ইসলামকেও ছাড় দিচ্ছে না তার নজির সমকালীন ঘটনা প্রবাহে ভুরিভুরি। আমি স্পষ্ট মনে করিউলামায়ে কেরামের অরাজনৈতিক অবস্থান থেকে, একান্ত আদর্শিক কনসেপ্ট থেকেই জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্বের দাবীর বিরোধিতা করা উচিত। যদিও সে রাজনীতি পূর্ণাঙ্গ শরিয়াহ সম্মত নয়। তবুও আমরা এইটা বলছি এইজন্য যাতে সেক্যুলারদের ইসলামবিদ্বেষকে পশ্রয় দেওয়া না যায়।

●শাহবাগের বুনিয়াদ যেহেতু ৭১ বা আরেকটু খুলে বললে ৭১ এর যুদ্ধাপরাধের বিচারের দাবি। তো উলামায়ে কেরাম বা বিশেষ করে আপনি ৭১ কে কিভাবে দেখেন? বেশ কিছু বছর আগে পিনাকি ভট্টাচার্য নামে এক বামপন্থী লেখক‘মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম’নামে এক বই লিখেছেন, যা ইতিহাসবিকৃতির এক অনন্য নজির। কওমী ঘরানার অনেক উলামায়ে কেরাম এবং তরুণ তালিবুল ইলমদের একটা বড় অংশের কাছে পিনাকি ভট্টাচার্য ও তার এই বই যথেষ্ট সমাদৃত ও উদযাপিত। বইটি আপনি পড়েছেন কি? উলামায়ে কেরাম মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি এমন একটি চিত্র নির্মিত হয়েছে এখানে। সকল উলামায়ে কেরাম কি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলেন? মাওলানা হাফেজ্জী হুজুর, মাওলানাআতাহার আলী, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম ও নেজামেইসলামির একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে যদি কিছু বলতেন।

●●একাত্তর নিয়ে আমার কোনো সুনির্দিষ্টভাবে বলার আর কিছু নেই। কেননা গলত গোড়াতেই রয়ে গিয়েছিল।ওয়াহাবি আন্দোলন বা মুজাহিদ আন্দোলনের ব্যর্থতার ভিতর দিয়ে মুসলিমদের নেতৃত্বাধীন যে পাকিস্তান আন্দোলন হয়েছিল, তাতে উলামায়ে কেরামের আশা পূরন হয় নাই। এই আন্দোলনের মূল নায়কগণ ছিলেন ব্রিটিশবান্ধব মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজের লোকজন। তারা ইসলামের পিওরলিডারশীপ ছিলেন না। হিন্দু জাতীয়তাবাদী পুনর্জাগরনের বিকল্পে আধুনিক ভিত্তিতে মুসলিম ভূমি ভিত্তিক ফর্মেটে তারা ক্ষমতার ভাগ বাটোয়ারায় ইংরেজদের উপনিবেশী এবং ইউরোপীয় মডেলেই পাকিস্তান গড়তে চছেন। আধুনিক ইসলামি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা তাদের মূল স্বপ্ন ছিল না। হিন্দু ভারতে প্রশাসনিকক্যাডাররা ব্রিটিশ ক্ষমতার উত্তরাধিকারী হয়েছে তদ্রূপ মুসলিম পাকিস্তানে মিলিটারি ব্রিটিশক্ষমতার উত্তরাধিকারী হয়েছে। উভয় শ্রেণি পশ্চিমাদের অনুসারী। পাকিস্তান রাষ্ট্রের অর্গানিক জন্মটাই ইসলামী কায়দায় পরিপূর্ণ ভাবে হয় নাই। উলামায়ে কেরামরা এখানে অংশ নিয়েছেন বটে, কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য তো পরিপূর্ন হয় নাই । তবে অংশত ইসলাম, অংশত পশ্চিমা ফিউশন টাইপ পাকিস্তানকেও অনেক উলেমা কেরাম মন্দের ভালো হিসাবে নিয়েছিলেন। আর পিনাকির মুক্তিযুদ্ধের বয়ানে ইসলাম নামক বইটি এই দৃষ্টিকোণে আমার কাছে স্বাভাবিকভাবেই অগ্রাহ্য, কারন অনেক ওলামারাই পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন। তবে বাংলাদেশে ইসলাম বনাম ধর্মনিরপেক্ষবাদী মুক্তিযুদ্ধেরচেতনার নানা বিতর্ক ও ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ায় বইটি উগ্র চেতনাবাদীদের বিরুদ্ধে একটা আঘাত। সেটাকে অতটুকুতে সীমাবদ্ধ রাখা যায়। কিন্তু ইসলামপন্থীরা এটাকে তাদের মূল চিন্তার খোরাক বানিয়েছে—তা নিতান্তই তাদের হীনম্মন্যতার পরিচায়ক এবং তাদের ইতিহাস বিস্মৃতির আলামত।

●শাহবাগ আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ এবং শাহবাগপন্থী বুদ্ধিজীবীরা ইসলামপন্থাকে নির্মূল করার জন্য ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল বা বিশেষ করে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব দিয়েছিল। আপনিসহ অনেকেই মনে করেন, ইসলামপন্থা অনেক আপোষকামী। তথাকথিত মডারেট শব্দ দিয়ে

হয়তো ইসলামপন্থাকে বর্গায়ন করে অনেকে৷ ইসলামপন্থা বিদ্যমান রাজনৈতিক বাস্তবতায় যেভাবে সেক্যুলারক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করে তা ইসলামপন্থা-বিরোধী অরাজনৈতিক উলামায়ে কেরাম কেন করতে পারেনা?

●●শাহবাগে ইসলামী রাজনীতি নিষিদ্ধের যে দাবি তুলেছে সেটা আকিদার আদর্শিক মানদণ্ডে আমরা নাকচ করি৷কিন্তু তার মানে এই নয় যে, প্রচলিত রাজনৈতিক ইসলামপন্থা শরিআর মূলনীতি দ্বারা বিশুদ্ধ ভাবে পরিচালিত। বরং এইটা একটা মডারেটপন্থা বেছে নিয়েছে যা ইসলামের বিশুদ্ধ রাজনৈতিক মেথডের সাথে হুবুহু যায় না। সেক্যুলার রাজনৈতিক এস্টাবলিশমেন্টকে চ্যালেঞ্জ করার কারণেই প্রচলিতইসলামি রাজনীতি বিশুদ্ধ হয়ে যায় তা নয়। বরং প্রচলিত ইসলামি রাজনীতি গণতন্ত্রের কাঠামোতেনিজেকে পরিচালিত করে পরোক্ষভাবে লিবারেলিজমকে স্বীকৃতি দিয়ে চলছে। তাই আপনি এটাকে কোনোভাবেসেক্যুলার ক্ষমতার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক চ্যালেঞ্জ বলতে পারেন না। বরং সেক্যুলার ক্ষমতার বিরুদ্ধেমূল চ্যালেঞ্জ হতে পারে একটি বিপ্লববাদী দাওয়াহ।

●আপনারকিছু খন্ডিত বক্তব্যের জেরে আপনার দোহাই দিয়ে প্রচলিত রাজনৈতিক কাঠামোয় অংশগ্রহণকারী ইসলামপন্থীদের বিরোধীতা করা হয়৷ আপনিও বেশ কিছু বক্তৃতায় সমস্ত ইসলামি দল বিলুপ্ত করবার প্রস্তাব করেছেন৷ শাহবাগ আন্দোলননেও ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করবার প্রস্তাব ওঠে৷ এদেশে জামায়াতে ইসলামীবাদেও উলামায়ে কেরামের রাজনৈতিক মুজাহাদা ও মেহনত অনেক। উলামায়েকেরামের একটি বড় অংশ রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। শামসুল হক ফরিদপুরীরহ.তথা সদর সাহেব হুজুর থেকে হাফেজ্জি হুজুর রহ., মুফতি আমিনি রহ.শাইখুল হাদীস আজিজুল হক রহ.তাদেরমাঝে অন্যতম। আপনার শ্রদ্ধেয় পিতাও নেজামে ইসলামির সাথে সংযুক্ত৷ আপনার রাজনৈতিক দল বিলুপ্তিকরণ প্রস্তাব শাহবাগের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করাকে যৌক্তিক প্রমাণ করে কিনা? ধর্মতত্ত্বীয় বৈধতা দেয় কিনা? এ বিষয়ে আপনার কি খেয়াল?

●●শাহবাগ কর্তৃক ইসলামি দল নিষিদ্ধ আর আমার প্রচলিত ইসলামি দল প্রথার বিলুপ্তির দাবী কখনো একনয়। শাহবাগের উদ্দেশ্য ইসলামী দল নিষিদ্ধের মাধ্যমে ইসলামের বিলুপ্তিসাধন। আর আমার দাবীহলো প্রচলিত বহুদলীয় ইসলামপন্থা নিষিদ্ধ করে আরও অধিক শক্তিশালী নিরঙ্কুশ একক রাজনৈতিক ইসলামি জামাআহ তৈরি করা। সুতরাং আমাদের বক্তব্য কোনোভাবেই শাহবাগের দাবীকে ধর্মতত্ত্বীয় বৈধতা দেয় না। এমনকি যে সমস্ত উলামায়ে কেরামের কথা আপনি বলেছেন তারাও প্রচলিত বহুদলীয় ইসলামি রাজনীতির পক্ষে ছিলেন না। হাফেজ্জি হুজুর রহ খেলাফত আন্দোলনের একক প্লাটফর্মের অধীনে সকলকে আসতে বলেছিলেন। এর পূর্বে নেজামে ইসলাম পার্টিও আবির্ভূত হয়েছিল মুসলিম লীগের ইসলামী স্বার্থ বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে আলেম-উলামা ও ইসলামপন্থীদের একক রাজনৈতিক প্লাটফর্ম হিসেবে। পরবর্তীতে এই প্লাটফর্মগুলো ভেঙে যায়৷ যা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নামে বিকাশ লাভ করে।এমন ভেঙে যাওয়া প্লাটফর্মের ভগ্নাংশগুলোকে আপনি কীভাবে বলতে পারেন যে, এগুলো ইসলামের রাজনৈতিক শক্তি। বরং এইসব তো ইসলামের নামে ইসলামি রাজনীতির পথে অন্তরায়। আমি আবারও আমার বহুদলীয় ইসলামি রাজনীতিপন্থার বিরুদ্ধে একক জামাআহ-ইমারার প্রতি সকলের দৃষ্টিআকর্ষণ করছি।

●আবারওএকটু একাত্তর প্রসঙ্গে যাই। মার্কসবাদী বুদ্ধিজীবিদের একাংশ ৭১ কে জালেমের বিরুদ্ধেমজলুমের লড়াই বলে চিত্রায়িত করে৷ একই বয়ান দেখা যায় কাওমির মাদ্রাসার তরুণ প্রজন্মেরমাঝে। কিন্তু আমরা যখন ইতিহাসের দিকে তাকাই, তখন দেখি অবাঙালি বা বিহারি গণহত্যা৷ ব্লাডএন্ড টীয়ার্স,ডেড রেকনিং, ফিফটি ইয়ার্স অফ বাংলাদেশ সহ বিদ্যাজগৎ এর অনেক বই এবং বিদেশিসাংবাদিকদের মাধ্যমে তা প্রমাণিত। ইয়াসমিন সাইকিয়া নামে আসামীয় এক ভদ্রমহিলা একাত্তরে নারীদের ধর্ষণ নিয়ে তার বই‘Women, War and The Making of Bangladesh : Remembering 1971’তে বিশদ আলোচনা করেছেন৷সেখানে বাঙালি নারীদের পাশাপাশি অবাঙালি বা বিহারি নারীদের ধর্ষণের প্রমাণ হাজির করা হয়েছে৷ অবাঙালিদের সম্পদ লুন্ঠন করা হয়েছে। গবেষণায় দেখা যায় নোয়াখালী, সন্দীপ, লক্ষীপুর, চাঁদপুর সহ অনেক জেলায় নিরীহ উলামায়ে কেরামকে হত্যা করা হয়েছে৷ এই গণহত্যা, ধর্ষণ,লুন্ঠন যে বাঙালি যোদ্ধারাই করেছে তা প্রমাণিত। ৭১ যদি জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের সংগ্রাম হয় তাহলে, ধর্ষিত মুসলিম বিহারিরা কি জালেম? উলামায়ে কেরাম যদি জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের সংগ্রাম হিসাবে বলে তাহলে বিহারি নারী এবং তাদের সম্পদ কি গনিমতের মাল? ৭১ কি তাহলে জিহাদ? আপনার মুল্যায়ন যদি জানাতেন৷

●●৭১ কে জালেমের বিরুদ্ধে মাজলুমের লড়াই বলার একটা ট্রেন্ড ইতোমধ্যে কওমি অঙ্গনেও চালু হয়েছে।এইটা ৭১ এর একটা খণ্ডিত মূল্যায়ন। সামগ্রিক মূল্যায়ন নয়৷ এটাকে কেউ সামগ্রিক বক্তব্য হিসেবে ধারণ করলে নানান ঐতিহাসিক কারণে তা নাকচ হতে বাধ্য। যেমন বিহারীদের প্রসঙ্গটা আপনি নিজেই তুলেছেন। তাছাড়া আমি পূর্বেই বলেছি সমস্যা গোড়াতেই। অর্থাৎ মুসলিম লীগে এবং পাকিস্তান সৃষ্টির জন্মতেই। যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব ব্রিটিশ আমলে তৈরি হয়েছিল, ৭১ তারই ধারাবাহিকতা। তবে ভিন্নরূপে ভিন্ন সংস্করণে ভিন্ন বয়ানে। নিঃসন্দেহে পাকিস্তান বাংলাদেশের উপর জুলুম করেছে এবং বাংলাদেশী জনগণের বিরুদ্ধে তাদের মানসপটে একটা অহমিকাও ঘৃণাবোধ কাজ করে।এবং বাংলাদেশে তাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শোষণের ব্যাপারটাও অনস্বীকার্য। তাই বলে বাংলাদেশের রাজনীতিবিদরা নৈতিক মানদণ্ডে নির্দোষ ছিলেন—এমন বলারও কোনো জো নেই। একাত্তরে যাদেরকে মাজলুম বলা হচ্ছিল তারাই একাত্তর-পরবর্তী নিকৃষ্ট জালেমের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে অদ্যাবধি। তাহলে এই সময়টাতে কেন বলা হচ্ছে না জালেমদের বিরুদ্ধে মাজলুমদের আরেকটা সংগ্রাম হওয়া চাই।

●শাপলায় ফেরত আসি। শাপলার আন্দোলনের ১৩ দফার পয়লা দফা সংবিধানসংক্রান্ত।সংবিধানে‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’নিয়ে প্রস্তাবটা ছিল। ইতিহাসের আয়নায় দেখলে, এটা অনেকটা শহিদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানপ্রদত্ত সংবিধানে ফেরত যাবার মতোন শোনায়৷আপনি কি মনে করেন এই দফার মাধ্যমে শাপলা সংবিধানে হাকিমিয়্যা যুক্ত করবার প্রস্তাবকরা করেছিল?

●●‘আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’এইটা সংবিধানে জিয়াউর রহমান নিয়ে এসেছিলেন। পরবর্তীতে আওয়ামীলীগ এইটাকে বিলুপ্ত করে। হেফাজতের ১৩ দফায় এইটা পুনঃস্থাপনের দাবী তোলা হয়েছে। এইটামন্দের ভালো। কেননা এর মাধ্যমে আক্ষরিকভাবে হলেও ধর্ম নিরপেক্ষবাদ শব্দটি বাদ পড়ে। যদিও এর মাধ্যমে আল্লাহর হাকিমিয়্যাহ সাংবিধানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় না। কেননা আমাদের সংবিধানেরমূল কাঠামোই মানবরচিত মতবাদের দ্বারা গঠিত। এমন আধুনিক ফর্মেটে দুএক জায়গায় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করলে তাতে সংবিধান পবিত্র ও নিষ্কলুষ হয়ে যায় না। আসলে হেফাজতে

ইসলামের দাবীগুলো মৌলিকভাবে অসম্পূর্ন। এই জাতীয় দাবি উপস্থাপন কর্তৃপক্ষকে পরোক্ষভাবে কিছুটা বৈধতা দানের শামিল। মূলত আমরা গোড়া থেকেই সংস্কার চাই এবং পুরো সিস্টেম টাকেই নাকচ করে যথাযথ দাওয়াহদিতে চাই।

●আমরা জানি যে আপনি‘শুহাদায়ে শাপলা’ রপরিবারগুলোর সাথে যোগাযোগ রক্ষা করেন৷ তাদের আর্থিক সহায়তা, তাদের জন্য কোরবানি ইত্যাদি কাজে আপনাকে তারা পাশে পেয়েছে৷ ‘শুহাদায়ে শাপলা’-র সংখ্যা আসলে কত? মানবাধিকার সংস্থা‘অধিকার’এর বরাতে বলা হয়—প্রাথমিক ধারণানুসারে এই সংখ্যা ৬১, ঘাতক দালালনির্মূল কমিটির গণতদন্ত কমিশন রিপোর্টমতে এই সংখ্যা ৩৯। আজও‘শহিদানে শাপলা’-রকোন পরিসংখ্যান করা হয় নাই। এই দায় কার? ৫ইমে রাতের গণহত্যা নিয়ে উলামায়ে কেরাম তদন্ত কমিশন গঠন করবার প্রস্তাব কেন করছেন না? আপনার সাথে কতজন ‘শহিদানে শাপলা’-র পরিবারের যোগাযোগ আছে?

●●শাপলার শহিদদের গণনায় বিভিন্ন সংস্থার হিসাবে গড়মিল থাকাটা স্বাভাবিক। কারণ মূল আক্রমণ রাতেরগভীরে হলেও প্রোগ্রাম শুরু হওয়ার অনেক আগে থেকেই সংঘাত ছড়িয়ে পরে এবং তখন থেকেই শহিদদের লাশ পড়তে থাকে। যা ৫ মে পরবর্তী কয়েকদিন পর্যন্ত অব্যাহত ছিল। তাই এখানে একাধিক ঘটনাযুক্ত হওয়ায় একেক সংস্থার রিপোর্টে একেক সংখ্যা উঠে এসেছে। আমার অফিসে তার একটা পূর্ণাঙ্গতালিকা ছিল যা বারংবার গ্রেফতার হওয়ার কারণে সে তালিকা সংরক্ষণ রাখা ও সেমতে কার্যক্রম অব্যাহত রাখার সুযোগ বিনষ্ট হয়েছে। তবে আমরা এই বিষয়ে একটি গঠনমূলক সিদ্ধান্তে পৌঁছব ইনশাআল্লাহ।

●শাপলারপরে উলামায়ে কেরামের উপর জেল জুলুম এবং একইসাথে শাপলা-উত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক গুম, খুন, সহিংসতা, মামলা জুজু ইত্যাদি নিয়ে যদি বলতেন একটু৷ আজকাল অনেকেই বলতে চায় শাপলাতেএভাবে আন্দোলনে যাওয়া উচিত হয়নি। এই চিন্তাকে কিভাবে মূল্যায়ন করবেন?

●●শাপলারআন্দোলনের দুইটি দিক।

১. আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক

২. রাজনৈতিক

আমরা স্বীকার করি—রাজনৈতিকভাবে শাপলা আন্দোলন পরিপূর্ণ কল্যাণ বয়ে আনেনি। তবে আমাদের মূললক্ষ্যটা যতটা রাজনৈতিক তারচেয়ে বেশি ছিল আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক। আর এই জায়গায় শাপলার আন্দোলন কেবল সাফল্যই লাভ করেনি বরং বাংলাদেশে ইসলাম বনাম ধর্মনিরপেক্ষবাদের চিরন্তন লড়াইয়ে এই আন্দোলনটি ইসলামের পক্ষে সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক বিজয়ের একটি মাইলফলক রচনা করে। শাপলা আন্দোলনের আগে সেক্যুলার প্রোপাগাণ্ডার কারণে ইসলামপন্থা একটা চাপে ছিল।সর্বত্র মৌলবাদী, চরমপন্থী, জঙ্গি-রাজাকার এইসবের একটা জুজু আমাদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিকআবহে কার্যকর ছিল। শাপলা পরবর্তী দৃশ্যপট পাল্টে যায়। বরং উল্টো সেক্যুলার গোষ্ঠী নাস্তিক্যবাদেরঅভিযোগে অভিযুক্ত হয়ে গণমানুষের কাছে ধিকৃত হয় এবং যে আত্মরক্ষার কৌশল একসময় ইসলামপন্থীদের বৈশিষ্ট্য ছিল সেই আত্মরক্ষাই এখন সেক্যুলারদের কৌশলে পরিণত হলো। তারা বর্তমান বাংলাদেশে নিজেদেরকে নানানভাবে এইকথা প্রমাণে সচেষ্ট যে, তারা ইসলামবিদ্বেষী নয়, তারা

খোদাদ্রোহি নয়, তারা নাস্তিক নয়, তারা রাসুলের কটূক্তিকারি নয়। মোটামুটি শাপলা-আন্দোলন সুস্পষ্টত বাংলাদেশকে আদর্শিকভাবে দ্বিখণ্ডিত করে দেয়। একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ আস্তিক, অন্যদিকে সংখ্যালঘুনাস্তিক। রাজনৈতিক জয়-পরাজয় নির্ভর করে সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক জয়-পরাজয়ের উপরে। এখন এই জায়গায় হেফাজতে ইসলামের ব্যর্থতা যে, একটা আদর্শিক ও সাংস্কৃতিক জাগরণকে তারা ইসলামের রাজনৈতিক বিজয়ের পথে ঐভাবে ধাবিত করতে পারেনি। তো আপনি যেমনটা বলেছেন শাপলার একটা রাজনৈতিক ব্যর্থতার দায়ভার হেফাজতে ইসলামকে নিতেই হবে। শাপলা ম্যাসাকারের মাধ্যমে রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির স্পর্ধা বেড়ে যায়। নিপীড়ন ও জুলুম তাদের জন্য সহজ হয়ে যায়। আর এমন হওয়াটা স্বাভাবিক।কেননা যেকোনো বিজয়ী শক্তি তার বিরুদ্ধবাদী শক্তিকে পরাজিত করেই ক্ষান্ত থাকে না, তাকে চূড়ান্ত আপোষকামিতায় আসতে বাধ্য করে। শাপলার রাজনৈতিক ব্যর্থতার মাশুল কেবল ইসলামপন্থীদের কে দিতে হয়নি বরং সকল বিরোধীদলকেই দিতে হয়েছে এবং হচ্ছে। এসব বাস্তবতাকে অস্বীকার করার কোনো জো নেই। এইজন্য হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক দুর্বলতাই মূল কারণ। শাপলা পরবর্তী দুয়েকবছরের মধ্যে কীভাবে আমরা ঘুরে দাঁড়াতে পারি তার কিছু পরিকল্পনা নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে সংগঠনের মধ্যে কাজ শুরু করেছিলাম। কিন্তু অনাকাঙ্ক্ষিত রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যদিয়ে আমাকে দীর্ঘসময়ের জন্য তখনই জেলে চলে যেতে হয়। আর এমনিভাবে পুনর্জাগরণের নতুন প্রক্রিয়াটি মুখ থুবড়ে পড়ে। কেননা আমাদেরকে সহকর্মী ভাইদের মধ্যে প্রয়োজনীয় উপাদানও যোগ্যতার মারাত্মক ঘাটতি ছিল।তিন বছর পর আমি জেল থেকে বের হয়ে সম্পূর্ণভাবে হেফাজতে ইসলামকে নতুনরূপে দেখতে পাই। যার আগাগোড়াই ছিল আপোষকামিতা। তবে এখানে একটি কৌতূহলীবাস্তবতা রয়েছে। সে বাস্তবতাটি হল—রাজনৈতিক কারণে ক্ষমতাসীন সরকার হেফাজতে ইসলামের প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামীর ন্যায় জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ না করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান গ্রহণ করে। তারা একদিকে যেমন হেফাজতে ইসলামকে আপোষকামী হতে বাধ্য করে, অন্যদিকে নিজেরাও অনেক আদর্শিক প্রশ্নে হেফাজতে ইসলামের কাছে আপোষমূলক আত্মসমর্পণকরে। যার প্রভাব আমরা দেখতে পাই শিক্ষা সিলেবাসের বিভিন্ন সংস্কারের মধ্য দিয়ে এবং কওমি মাদ্রাসা সনদের স্বীকৃতির মধ্য দিয়ে। ইতোমধ্যে হলি আর্টিজানের ঘটনা সরকার ও কওমি শক্তিকে আরও কাছাকাছি নিয়ে আসে। আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে হেফাজতে ইসলামের সাথে রাজনৈতিক লেয়াজু নেতৃত্ব দিতেন প্রধানমন্ত্রীর সামরিক উপদেষ্টা ড. তারেক সিদ্দিকি এবং রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচটি ইমাম সহ অন্যরা। সরকারের নীতি নির্ধারণী মহল থেকে হেফাজতে ইসলামের সাথে আপোষের বিষয়টি রাগ-ক্ষোভ ছাড়াই স্বীকার করা হয়। সুতরাং যে কৌতূহলী বাস্তবতার কথা আমি এখানে বলতে চাচ্ছিলাম তা হলো—শাপলা-পরবর্তী রাজনৈতিক ফ্যাসিজমের উৎপাত বৃদ্ধি পেলেও এবং তা ইসলামের রাজনৈতিকপন্থাকে অক্ষম করে দিতে পারলেও ইসলামের আদর্শিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক দিকসমূহের সাথে আপোষ করতে বাধ্য হয়। আর এমনিভাবে পলিটিক্যাল ইসলাম শাপলা পরবর্তী হুমকির শিকার হলেও কালচারাল ইসলাম নিজেকে অক্ষত রেখে বরাবরই সেক্যুলারিজমের বিপক্ষে চ্যালেঞ্জ হিশেবে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে। সুতরাং যারা শুরু থেকে রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশের মানদণ্ডে এইভাবে হেফাজতে ইসলামের শাপলা চত্বরে যাওয়াকে সমর্থন করে না তাদের চিন্তাটা ভুল। কারণ বিষয়টি সামগ্রিকভাবে মূল্যায়নযোগ্য। শুধু রাজনীতির বাহ্যিক ও স্থূল পর্যবেক্ষণ যথেষ্ট নয়।

●ইসলামের রাজনৈতিক ইতিহাসে যারা জেলখানায় অত্যাচারিত-নির্যাতিত হয়েছেন, তাদের নানান এথিকাল, সাইকোলোজিক্যাল ও পলিটিকাল-স্পিরিচুয়াল প্র্যাক্টিসে ভিসুয়ালাইজেশন এবং ইসলামিক অলৌকিকস্বপ্নের দ্বারা নিজেদের রক্ষা করতে পেরেছিলেন।আপনার নিজস্ব অভিজ্ঞতায় এইরকম কোনো ইসলামিক চর্চা কি ছিল? আপনি কিভাবে মোকাবেলাকরলেন সেক্যুলার টর্চার টেকনিক এবং স্ট্রাটেজিগুলোকে?

●●স্বপ্ন, কারামত ও এই জাতীয় অলৌকিক বিষয়গুলো নবী, সাহাবা ও আওলিয়াদের জীবন সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্যঅংশ। সবগুলো হাদিসগ্রন্থে স্বপ্নের একটি অধ্যায় রয়েছে। খ্যাতিমান পশ্চিমা নওমুসল দার্শনিকমুহাম্মদ আসাদ তার ‘রোড টু মক্কা’গ্রন্থে স্বপ্ন শিরোনামে একটি চ্যাপ্টার রেখেছেন।হাদিসের ভাষ্যমতে শেষ জামানায় মুমিনগণ স্বপ্নের মাধ্যমে আল্লাহর পক্ষ থেকে ব্যাপকভাবেসাহায্যপ্রাপ্ত হবে। আলহামদুলিল্লাহ সত্য বলতে কি আমাদের আধ্যাত্মিক কোনো উঁচু অবস্থাননা থাকলেও সাধারণ মাজলুম একজন ইমানদার দাওয়াতি কর্মী ও মুজাহিদ হওয়ার সুবাদে অনেকগুলোস্বপ্ন আমাদেরকে বিপদের সময়ে বিভিন্ন দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে। অনেকগুলো বিজয় ও বিপর্যয়েরপূর্বাভাস আমরা স্বপ্নের মাধ্যমে পেয়েছি। বস্তুত অধিক মাত্রায় গণযোগাযোগ আধ্যাত্মিকতাকেবিনষ্ট করে। নচেৎ আমার মনে হয় আরও অনেক অলৌকিক কিছু বিষয় আমাদের সাথে হয়তোবা ঘটতো।আপনি যেইভাবে প্রশ্নটি করেছেন, কোনো সাধারণ সাংবাদিক তো দূরের কথা, ইসলামপন্থীদের মধ্যেওপর্যন্ত এই বিষয়টি নিয়ে কোনো আলাপ হাজির নেই। আমি জামায়াত-হেফাজত এবং জিহাদি ধারারঅনেক ভাইদেরকে যখন স্বপ্ন বিষয়ে প্রশ্ন করি, তখন তারা অবাক চিত্তে আমার দিকে তাকিয়েথাকে। তারা বুঝতেই পারে না যে, এক অদৃশ্য অলৌকিক সত্তাতাদের বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণকরছে এবং স্বপ্নের মারফত তা তাদেরকে মাঝেমধ্যে কিছু কিছু জানান দেওয়া হয়। আফসোসের সঙ্গেবলতে হচ্ছে প্রচলিত ইসলামপন্থা যেনো পুরোটাই বস্তুবাদী। আধ্যাত্মিক অলৌকিকতার কোনোলেশমাত্র তারা নিজেদের মধ্যে রাখেননি। এইটা তাদের ইমানী প্রজ্ঞার অনুপস্থিতির সংকট।

●সাম্প্রতিক একটা খুতবায় আপনি বললেন যে,সেক্যুলারিজমএবং ইসলামবিদ্বেষী প্রবলেম শুধুমাত্র একটা সরকারের বিষয় না।সংস্কৃতিও(কালচার) একটা ইম্পরট্যান্ট ভূমিকা রাখে।আপনার এই পর্যালোচনা আরেকটু বিস্তারিত বলবেন ? আমিআপনার উক্তিকে দর্শনের জায়গা থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাবে নেই, কারণ কালচার শুধুমাত্র গানবাজনা, নাটক, জলসা না।সেক্যুলারিজমের জ্ঞানতত্ত্বএকটা কালচারের মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়।এই দার্শনিকএবং রাজনৈতিক জ্ঞানতত্ত্ব এর কালচারাল প্রোডাকশনের ইসলামিক ক্রিটিক হাজির করার ক্ষেত্রেউলামাদের কি ভূমিকা থাকতে পারে?

●●সেক্যুলারিজমকেআমি সমকালীন জাহিলিয়্যাহ মনে করি। আর এই জাহিলিয়্যার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশটি হলো পলিটিক্যালফেরাউনিজম। কিন্তু এই পলিটিক্যাল ধর্মহীনতাই সংকটের শতভাগ চিত্র নয়। আমি বলতে চাই, রাজনৈতিক ধর্মহীনতার মূল উৎপত্তিস্থল হলো সাংস্কৃতিক ধারা। শিক্ষা ও সমাজ-সবকিছু যারঅন্তর্ভুক্ত। সোশ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ডে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক চেতনাই পরবর্তী স্টেইজে রাজনৈতিকরূপ পরিগ্রহ করে থাকে। আর তাই রাজনৈতিক সেক্যুলারিজমকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করা দুরূহহয়ে ওঠেছে। রাজনৈতিক সেক্যুলারিজমের ভিত্তি দুর্বল করার জন্য তার সামাজিক ও সাংস্কৃতিকজায়গায় আঘাত হানা জরুরি। আমার লিখিত ‘চেতনার ইশতেহার’বইয়ে বলেছি আল্লামা আবুল হাসান

আলী নদভির মতো বস্তুনিষ্ঠ গবেষকগণ ইখওয়ানুল মুসলিমীন সম্পর্কে যে পর্যবেক্ষণ ব্যক্তকরেছেন তাতে তাঁরা মনে করেন—দাওয়াত-বিমুখতা এবং প্রস্তুতির পূর্বে রাজনৈতিক ময়দানেঅবতীর্ণ হওয়াটাই ইসলামি আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ। অবশ্য সেক্যুলার রাষ্ট্রযন্ত্র যেদাওয়াতি কাজেও চরম বৈপরীত্য প্রদর্শন করেনি তা নয়। ইসলামি আন্দোলন নির্বাচনমুখী গণতান্ত্রিকরাজনীতি-চর্চাকে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার বাহন মনে করে বিপ্লবের মহান লক্ষ্য থেকে ছিটকেপড়ে গতানুগতিক রাজনীতির গর্ভে নিজেকে বিলীন করে ফেলে।

রাজনৈতিককার্যক্রমকে অব্যাহত রাখার তাগাদা থেকে জাহিলিয়াতের রাজনৈতিক, সামাজিক কাঠামোর সাথেআপোষের পথ বেছে নিতে হয়েছে ইসলামি আন্দোলনকে। ইকামাতে দীনের লক্ষ্যে মহানবী সাল্লাল্লাহুআলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর সিরাতে দাওয়াতে দীনের যে পদ্ধতি রেখে গেছেন তা ইসলামি আন্দোলনেরসমকালীন অনুশীলনে আধুনিক নিয়মনীতির মধ্য হারিয়ে যায়।

ইসলামিআন্দোলন কর্তৃক পাশ্চাত্যের আদলে দল গঠন এবং সে আদলে কর্মসূচি প্রণয়নের দ্বারা সেক্যুলারএস্টাবলিশমেন্ট একটি রাজনৈতিক হুমকি অনুভব করে, যা তাদের ক্ষমতাকে চ্যালেঞ্জ করবে।ইসলামি আন্দোলন এমন বার্তা দিতে পারেনি যে, আমরা মসনদ দখল করতে চাই না—বরংসেটা সংস্কার করতে চাই। দাওয়াতের এ সরল উদারতার স্থলে প্রতিপক্ষকে রাজনৈতিক জটিল বার্তাদেয়া হয়েছে। ইসলাম বনাম তাগুতের দ্বন্দ্ব পরিণত হয়েছে ইসলামি দল ও সেক্যুলার দলের রাজনৈতিকলড়াইয়ে।

●ইবনেতাইমিয়াকে যখন কারাবন্দী করা হত তখন উনি কারাগারেই দাওয়াতি কাজ করতেন৷কারাগারের আসামিদেরদীন-দুনিয়া নিয়ে ভাবনা কেমন, আপনার দাওয়াতি অভিজ্ঞতা শুনতে আগ্রহী। কারাগারে আসামীদেরনসিহতের জন্য বা দাওয়াতি প্রকল্প চালানোর কোন নিদিষ্ট প্ল্যান আপনার আছে কিনা? শাইখ আহমাদুল্লাহএকবার পুরুষ আসামিদের স্ত্রীর হকসংক্রান্ত আলাপ এনে ইসলাহী-ইসলামি বুনিয়াদেসংক্ষিপ্ত কারাগার প্রকল্প রূপরেখা প্রস্তাব করেছিলেন। এই বিষয় নিয়ে আপনার সুচিন্তিতমতামত জানতে আগ্রহী।

●●একটাগুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন আপনি তুলেছেন। জি আলহামদুলিল্লাহ আমরা কারাগারে ব্যাপক দাওয়াতিকাজ করেছি, আমাদের উপর হাই প্রোফাইল রেস্ট্রিকশান ছিলো, তাই যথেষ্ট সীমাবদ্ধতার ভেতরকাজ করতে হয়েছে। আলহামদুলিল্লাহ প্রশাসনের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি সত্ত্বেও সাধারণ বন্দীদেরমধ্যে আমাদের একটা ক্যারিশমাটিক অবস্থান ছিলো। মানুষ আমাদের কথা গ্রহণ করতো। আর আলেমসমাজেরপ্রতি গণমানুষের একটা প্রথাগত ভালোবাসা তো জেলের বাইরেও দৃশ্যমান। এমন সেন্টিমেন্ট আমাদেরদাওয়াতি মিশনকে সহজ করেছে।আমরাশিক্ষিত তরুণদেরও বুদ্ধিবৃত্তিক দাওয়াতি মোটিভেশান করতাম। তার জন্য আংশিক সাংগঠনিকরূপ দেওয়ার চেষ্টা করতাম তবে ব্যাক্তিগত উদ্যোগই সাংগঠনিক পদ্ধতির চাইতে অধিক কার্যকরীছিলো।

এটানিয়ে মুক্তির পর একটা পরিকল্পনা গ্রহণ করতে চাই আমি, তবে হেফাজতে ইসলামের সহকর্মীদেরএ বিষয়ে অনুভূতি তেমন জাগ্রত না, অনেকেই ভেতরে থাকাকালীন কিছু দাওয়াতি কাজ করেছেন, তবে মুক্তির পর সেটা নিয়ে ভাবনার ধারাবাহিকতা বজায় রাখেননি।

আমিএকটা লিখিত রূপরেখা তৈরীর চিন্তাভাবনা করছি।এখানেসরকারের সহযোগিতার বিষয়টি অপরিহার্য।

আমিএকটা প্রস্তাব প্রিজন ডিআইজিকে দিয়েছিলাম এবং তা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রেরসর্বোচ্চ জায়গায় পৌঁছাতে ইচ্ছা করছি।

প্রস্তাবটিহলো সকল কারাগারে ডিপুটি জেলার পদমর্যাদা একজন শরীআহ্ কনসালটেন্ট নিয়োগ করা। শাইখ আহমাদুল্লাহরপরিকল্পনা সম্পর্কে আমার কোনকিছু জানা নেই। হলে তা নিশ্চয় আশাব্যঞ্জক।

ইনশাআল্লাহএব্যাপারে আপনারা আমাদের প্রস্তাবনা দেখতে পাবেন। আমরা আক্ষরিক দাওয়াতই নয় বরং জেলখানারসামগ্রিক সংস্কার নিয়ে কাজ করতে চাই। মনে রাখতে হবে,মানবিকতা দাওয়াতের অন্যতম অনুষঙ্গ, এটা সহীহ হাদীসে স্বয়ং নবীজি ও তাঁর সাহাবাদের বিষয়ে বলা আছে।

আমরাকারাসংস্কারে একটা বৃহৎ দাওয়াতি মানবিক প্রকল্প গ্রহণ করতে সচেষ্ট হবো ইনশাআল্লাহ।

●আপনিবলেছিলেন, কওমি অঙ্গনে এক রকমের কওমী সেক্যুলার গড়ে উঠতেছে, যারা অত্যন্ত ভয়ঙ্কর। এবিষয়ে কি একটু বিস্তারিত জানাবেন? এটা কিভাবে সম্ভব হলো? এর সম্ভাব্য ফলাফল কি? এইধারার বৈশিষ্ট্য-প্রবণতাসমূহ কি কি? এই সমস্যার সমাধানের পথ কি?

●●ইবনেখালদুনের একটি সমাজতাত্ত্বিক বয়ান রয়েছে। যেখানে তিনি দেখিয়েছেন পরাজিতশ্রেণি বিজয়ীশক্তিরমানসিকতা গ্রহণ করতে একপর্যায়ে বাধ্য হয়ে যায়। দীর্ঘ আওয়ামী সেক্যুলার শাসনামলেআমরা তা-ই দেখতে পাচ্ছি অসংখ্য দৃষ্টান্তের মধ্য দিয়ে। তারও আগে থেকে আমরা প্রচলিতইসলামপন্থার মধ্যে ইনফিরিয়োরিটি কমপ্লেক্স লক্ষ করে আসছি। আধুনিক সভ্যতার উত্থানেরপর থেকেই বৃহত্তর মুসলিম সমাজে এই হীনম্মন্যতা মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়লেও ইসলামি পুনর্জাগরণবাদীদেরমধ্যে তার বিপরীত প্রবণতা অর্থাৎ ইসলামকে বিজয় করার শক্তিটাই দৃশ্যমান ছিল। কিন্তুপরবর্তীতে কালের আবহে ইসলামপন্থার মধ্যে দীর্ঘ আন্দোলন ও সংগ্রামের ব্যর্থতার দরুনহতাশার মধ্য দিয়ে এই ইনফিরিয়োরিটি কমপ্লেক্সটি তৈরি হয়, যা একসময় কেবল আওয়ামের মধ্যেছিল। আমার কওমি সেক্যুলার পরিভাষাটি এইসব কারণেই। শাহবাগে একজন স্বনামধন্য মুফতির উপস্থিতি, জিহাদ-বিরোধী ফতোয়ায় সাক্ষরগ্রহণ, শোকরানা মাহফিল, জাতীয় সংগীতকে বৈধতাপ্রদান, নানানজাতীয়তাবাদী দিবস উদযাপনকে ইসলামীকরণ, বহির্বিশ্বে ইন্টারফেইথে উলামাদের অংশগ্রহণ, ব্রাকের প্রতিষ্ঠাতা ফজলে হাসান আবাদের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ ও ব্রাকের ভূয়সীপ্রশংসা, মুভ ফাউন্ডেশনের সাথে সম্পৃক্ততা, হাদিসের মসনদে জালেম ক্ষমতাসীনদের প্রশংসা, জিহাদি চিন্তাধারার উপর মানহাজি ট্যাগারোপ, ব্যাংকবীমাসমূহের ব্যবসাকে অবাধভাবে স্বীকৃতিপ্রদান, বেফাকের বিভিন্ন কারিকুলামে জাতীয়তাবাদী বিষয়বস্তুর সন্নিবেশ ইত্যাদি হলো সমকালীনকওমি সেক্যুলারপন্থার একেকটি নিকৃষ্টতম উদাহরণ।

নিঃসন্দেহেএর ফলাফল শুভ নয় এবং এই প্রবণতার সমাধান রূদ্ধকরে এসব সংকটের সমাধানের পথ হলো—হেফাজতেইসলামের শক্তিশালী প্রতিবাদী অবস্থান এবং কওমি তারুণ্যের ব্যাপক দাওয়াতি মোটিভেশান।

●ক্ষমতা আর ক্ষমতায় আরোহণেরপদ্ধতির ভিতর কীসম্পর্ক বিদ্যমান?

●●ইসলামে রাজনৈতিক ক্ষমতাগ্রহণ জরুরি। সেটি ইসলামের একটি নিরঙ্কুশ বিধান। সালাফ থেকে খালাফ পর্যন্তসকল ধারার সকল ইমামগণ ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে এই অবস্থান নিয়েছেন যে, ইমামত প্রতিষ্ঠা শরয়ীভাবে ওয়াজিব এবং নামাজের ইমামতের তুলনায় এটিকে ইমামতে কুবরা বলা হয়েছে। তবে ক্ষমতারোহণ পদ্ধতিসমূহ ইসলামে খুব বেশি মৌলিক নয়। সমকালীন ইসলামপন্থা ক্ষমতারোহনের পদ্ধতি সমূহের উপর অধিক আলাপচারিতা হাজির করে এটাকে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে প্রাসঙ্গিক করে ফেলেছে। ইসলাম একদিকে ক্ষমতা আরোহণের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি যেমন সমর্থন করে না, তেমনিভাবে ক্ষমতা আরোহণের শরিয়াভিত্তিক পদ্ধতিকেও পরিপূর্ণ অগ্রাহ্য করে না।

●সম্প্রতি জামায়াতে ইসলামী এবং অনেক কওমী ঘরানার ইসলামপন্থী দলকে একাত্তর-সম্পর্কিত স্বাধীনতার বয়ানকেগ্রহণ করে নিতে দেখা যায়। প্রশ্ন হচ্ছে, একাত্তর কেবলই পাকিস্তানের শোষণ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ব্যাপার নয়। শাহবাগ আন্দোলন এবং বাংলাদেশে ডোমিনেন্ট সেক্যুলার বয়ান অনুযায়ী, ৭১-এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ৪৭-এর দ্বিজাতিতত্ত্বকে ভুল প্রমাণিত করে। এই দ্বিজাতিতত্ত্বের একটি নিহিতার্থ হচ্ছে—মুসলিমরা তাদের নৃতাত্ত্বিক, ভাষিক ও সাংস্কৃতিক পার্থক্য সত্ত্বেওএকক রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে হাজির থাকতে পারে, যেটার সাথে খেলাফতের ধারণার খুব একটাপার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। পাকিস্তান হয়তো ইসলামী রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারে নাই, কিন্তু পাকিস্তানের এই ভিত্তিগত ধারণাকে কিভাবে ইসলামপন্থী হিসেবে অস্বীকার করা যেতে পারে? হয়তো এই চিন্তা থেকেই ৭১-এ জামায়াতে ইসলামী, নেজামে ইসলামসহ অনেক ইসলামী রাজনৈতিক দলও ব্যক্তিত্বগণ পাকিস্তান ভাঙার বিরোধিতা করেছিলেন। এ কথা বলা খুব প্রজ্ঞাপ্রসূতহবে না যে, মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া সাধারণ বাঙ্গালীদের চিন্তায় সেক্যুলারিজম, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ ইত্যাদির কোন স্থান ছিল না; তাদের চিন্তা ছিল কেবলই পাকিস্তানী শোষণ থেকেমুক্ত হওয়া আর সেজন্য ৭১-এর বয়ানকে ইসলামপন্থীরা আপন করে নিতেই পারে। এর কারণ, ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে যারা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নেতৃত্ব দিয়েছেন, তারা সন্দেহাতীত ভাবেই বাঙালী সেক্যুলার জাতীয়তাবাদী ছিলেন এবং তাদের বয়ানও সেভাবেই গড়েউঠেছে। আমরা জানি, ইতিহাসের বাক পরিবর্তন গুলোতে নেতৃত্বদানকারীদের কথাই পরিবর্তনের বয়ান নির্মাণ করে, তাদের পদাতিক সৈন্যদের মতামতের খুব একটা স্থান সেখানে হয় না। এ ব্যাপারে আপনার মত কি?

●●এই সম্পর্কে আমি কিছু কথা আগেই বলেছি। এইখানে আরও খোলাসা করে বলতে চাই, তুলনাটা যদি এমনহয় ইসলাম ভার্সেস পাকিস্তান আন্দোলন তাহলে পাকিস্তান আন্দোলন নিরেট ইসলামি না। এসব কথা আমরা আগেই বলেছি যে, অর্গানিকভাবে পিওর ইসলাম পাকিস্তান আন্দোলন না। তাহলে কি সেসময় মূলধারার উলামায়ে কেরাম ভুল করেছিলেন? না, আমরা তা-ও শতভাগ বলতে পারি না। কেননা তখন ইসলাম ভার্সেস পাকিস্তান আন্দোলন নয় বরং তুলনাটাছিল এমন, পাকিস্তান আন্দোলন বনাম হিন্দু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন। যা শরিআহ দৃষ্টিকোণে ফিকহের ভাষায় ‘আহওয়ালুল বলিয়্যাতাইন’বা মন্দের ভালো ছিল। আর এই বাস্তবতায় কোন কোন ইসলামপন্থী যে একাত্তর সম্পর্কিত স্বাধীনতার যে বয়ান গ্রহণ করেছে তা কুরআনিক আদল/ইনসাফনীতি পরিপন্থী। কেননা দ্বিজাতি তত্ত্বের কনসেপ্ট পিওর খেলাফত কনসেপ্ট না হলেও তা অবশ্যই হিন্দু-মুসলিম যৌথ জাতীয়তাবাদের ধারণার চেয়ে উত্তম। আর সেক্যুলারদের

ডাবল স্ট্যান্ডবাজি হলো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারের লড়াইয়ে মুসলিম জাতীয়তাবাদের প্রসঙ্গ কে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে টেনে এনে তাকে বদনাম করা। একাত্তর কোনোভাবেই দ্বিজাতিতত্ত্ব কে ভুলপ্রমাণ করতে পারে না। এ জাতীয় আস্ফালন ইতিহাস পরিপন্থী। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা কৃষক-শ্রমিক ও সাধারণ জনগণের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক চেতনা। এই চেতনাকে অপহরণ করেসেই জায়গায় তাজউদ্দিন গংদের সেক্যুলার আদর্শিক চেতনাকে যে রিপ্লেস করা হয়েছে তা ছিল বিশাল এক ঐতিহাসিক হিপোক্রেসি।

●শাহবাগ-শাপলা উত্তর বাংলাদেশে দেখা যায় শহুরে মধ্যবিত্ত বা নিম্ম মধ্যবিত্ত ইসলাম নিয়ে বেশ আগ্রহী৷ এরা কেউই ইসলামপন্থার রাজনীতি বাকওমি মাদ্রাসা বা কোন পীরের অনুসারী নয়। বরং এরা এদের সকলকে নাকচ করে। এদের একটা অংশরাজনীতি বাদ দিয়ে শুধুই দাওয়াতি মেহনতের বয়ান সামনে আনে। এই ধারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। আরেক ধারা আছে তারা ভায়োলেন্স এর মাধ্যমে খিলাফত কায়েমের প্রস্তাব করে। দু একজন গবেষক এদেরকে হিদায়েতি নামে অভিহিত করেছে৷ এরা পাকিস্তান রাষ্ট্রকে নাপাকিস্তান বলে।কিন্তু আমরা যদি ইতিহাসের দিকে তাকাই তাহলে দেখব যে জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের প্রধান শাব্বির আহমদ উসমানি পাকিস্তানকে নয়া মদিনা হিসাবে তত্ত্বায়ন করেছেন। শাব্বির আহমদ উসমানির পাশাপাশি বাংলারশর্শিনার পীর নেসারউদ্দিন, ফুরফুরার পীর, জৈনপুরের পীর, বাংলার তরিকায়ে মোহাম্মদীয়া, ব্রেলভি ধারা সহ নানা মাসলাক,মাজহাবের উলামায়ে কেরাম পাকিস্তান আন্দোলনকে জিহাদ বলেছেন।দেওবন্দের সাবেক মুফতি মাওলানা কাশুল উসমানি পাকিস্তান কায়েম করবার জন্য একমাত্র মুসলিমলীগ কে ভোট দেওয়া ওয়াজিব বলে ফতোয়া দিয়েছিল৷ শাব্বির আহমাদ উসমানি খুতবাতুল সাদারাতের কথাও মনে করতে পারি। যে ফরায়েজিরা ঔপনিবেশিক সময়ে রাজ্য দারুল হারব হওয়ার ফতোয়ায় আমলকরে ঈদ এবং জুমার নামাজ পড়ে নাই, তারা অবধি ৪৭ সালে উলামা সম্মেলন করে বলে পাকিস্তান দারুল ইসলাম। অতএব এখন ইদ এবং জুম্মার নামাজ পড়া বৈধ। সকল ধারার উলামাদের মুজাহাদা এবং মেহনতকে নাপাকিস্তান বলে খারিজ করে দেওয়াকে কিভাবে দেখেন? পাকিস্তান রাষ্ট্র এবং পাকিস্তান সরকার বা সেনাবাহিনীর মাঝে ফারাক করতে না পারার কারণ কি? এই ধারা আপনাকেসামনে রেখে তা পাকিস্তানকে খারিজ করে, মাওলানা তাকি উসমানি হাফি.কে শাইখুল কুফফার বলে৷ আপনার সাথে এই ধারার সম্পর্ক নিয়ে যদি বলতেন।

●●শাহবাগ-শাপলাউত্তর বাংলাদেশে শহুরে মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্ত ইসলামের দিকে যে প্র্যাক্টিসিং শুরু করেছেন তাকে আমি একটি নতুন ইসলামি জাগরণ মনে করি। প্রচলিত ইসলামপন্থার রাজনীতি, কওমি মাদরাসা এবং পীরের খানকাহ এসব হলো বেদাতে হাসানাহ। আর এর বিপরীত এই নতুন ইসলামি প্রজন্ম দাওয়াহ’র কথা বলে। আমি তাদেরকে অধিক স্বচ্ছ মনে করি। আরেকটা ধারা যারা জিহাদের মাধ্যমে খিলাফাহকে কায়েম করার প্রস্তাব করে। আপনি এইটাকে ভায়োলেন্স বলেছেন—যা আপত্তিকর। মূলত তারা হলেন গ্লোবাল জিহাদের অনুসারী। তারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে বৈশ্বিক জিহাদের ধারণা লালন করেন। মুসলিম বিশ্ব নিয়েও তাদের যে পর্যবেক্ষণ রয়েছে তা নাকচ করার মতো নয়। আর পাকিস্তান রাষ্ট্র বরাবরই একটি ফাসেক রাষ্ট্র। আমি আগেই বলেছি পাকিস্তান আন্দোলনের মাধ্যমে উলামায়ে কেরাম আশাহত হয়েছিলেন। অথবা মন্দের ভালো হিশেবে তারা সেটিকে বেছে নিয়েছিলেন। সেই যুগের আকাবিরগণ এখন বেচে থাকলে আমার মনে হয় তারা সবাই তালেবান হয়ে

যেতেন। এই ধারাকে মুসলিম বিশ্বের কন্টেক্সটে তাত্ত্বিক জায়গায় সমর্থন করাযায়। তবে তারা যদি বৈশ্বিক জিহাদের এপ্রোচকে মুসলিম দেশে দেশে টেনে আনেন তা সমর্থন যোগ্য নয়। আর তাদের এমন কোনো এপ্রোচ আছে বলে মনে হয় না। আর থেকে থাকলেও তা হবে কৌশল-পরিপন্থী। আকিদার মানদণ্ডে এরা সবচেয়ে বিশুদ্ধবাদী ইসলামি ফোর্স। আমাদেরকে এখন একটা সমন্বয়ে পৌঁছাতে হবে। মুসলিম দেশে দেশে সশস্ত্র জিহাদ এবং গণতন্ত্রের আপোষকামিতার মাঝামাঝি দাওয়াতি ধারাকে প্রমোট করা।

●নেজামে ইসলাম ছিল পাকিস্তান আমলে অন্যতম প্রধান ইসলামপন্থী দল। পাকিস্তান রাষ্ট্রে যতটুকু ইসলামিকরণ হয়েছে তার পিছনে জমিয়েতে উলামায়ে ইসলামের ভূমিকা অনেক। মাওলানা ভাসানি যখন কাগমারি সম্মেলনে পাকিস্তান কে আস সালামু আলাইকুম বলবে বলে বক্তব্য দিল৷ তার প্রতিবাদ স্বরুপ মাওলানা আতাহার আলি বললেন, ইসলামি পাকিস্তান জুমহুরিয়াত মাওলানা ভাসানিকেই আসসালামু আলাইকুম বলবে। যে নেজামে ইসলামি পাকিস্তান আমলে যুক্তফ্রন্টের সঙ্গে নির্বাচন করে, সেই নেজামে ইসলাম একাত্তরের পর হতে এখন অবধি আগের জৌলুস ফিরে পাচ্ছে না কেন? এখন কার নেজামে ইসলাম নিয়ে আপনার মূল্যায়ন কি?

●●নেজামেইসলাম পার্টি এখন একটি ভূঁইফোড় সংগঠনে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এটা নিয়ে এখন আর কোনো জরুরি আলাপ নেই। তবে ইসলামাইজেশানের ক্ষেত্রে তার প্রস্তাবনাসমূহ অতীতকর্মের কিছু মডেলকে আমরা আমাদের সমকালীন দাওয়াতি বয়ানে ব্যবহার করতে পারি। সেখান থেকে আমরা উপকৃত হতে পারি। বাকি তার সাংগঠনিক কাঠামোকে ফিরিয়ে আনার মধ্যে কোনো কল্যাণ নিহিত নেই।

●ব্রিটিশআমলের শুরু দিকে ব্রিটিশ আইনের পাশাপাশি শরিয়া আদালত চলত। পাকিস্তানেও কম হলেও শরিয়াকোর্ট আছে৷ উত্তর আমেরিকার কানাডাতেও নিদিষ্ট কিছু সময় শরিয়া কোর্ট চলেছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা এটাও দেখি যে সোভিয়েত ইউনিয়নের সায়ত্ত্বশাসনের আওতাধীন দাগিস্তান, চেচনিয়া, ককেশাস অঞ্চলেও অল্প সময় হলেও শরিয়া ছিল। বিদ্যমান আইন ব্যবস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশেশরিয়া কোর্ট হলে কেমন হবে? এমন শরিয়া আদালত হলে, আপনি কি তাকে গ্রহণকরবেন? বাংলাদেশেএকজন গ্র্যান্ড মুফতির পদ কেন তৈরি হল না এখনো? বাংলাদেশে একজন গ্র্যান্ড মুফতির জরুরতআছে কিনা?

●●আমাদের মূল দর্শনটা হলো একটা সামগ্রিক বিপ্লবাত্মক বিশুদ্ধবাদী সংস্কার। যা পুরো সিস্টেমকে নস্যাৎ করে নতুন একটি প্রথা পুনঃস্থাপন করবে। এইটা আমাদের মূল চিন্তা। তবে আপাতত এমনকোনো অভ্যুত্থানের সম্ভাবনা না থাকায় বিশুদ্ধ দাওয়াতি ফরমেটের ভিতর থেকে সত্যবাদী মুখলিস নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণে ইসলামাইজেশানের কিছু খণ্ডখণ্ড প্রকল্প হাতে নেয়া যেতে পারে৷যদিও নিঃসন্দেহে বিদ্যমান সেক্যুলার কাঠামোর ভিতর এমন ইসলামাইজেশান মারাত্মক একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয় এবং অতীতের ইসলামাইজেশান প্রকল্প আমাদের জন্য একটি ফেইল্ড এক্সপেরিমেন্টের নজিরবহন করে। তবুও আমরা বিশুদ্ধ দাওয়াতি আবহের মধ্য থেকে বর্তমানেও কিছু কিছু ইসলামাইজেশান প্রস্তাব করার চিন্তা করছি। তবে তা এই শর্তে যে, প্রচলিত গণতান্ত্রিক ইসলামি রাজনৈতিকনেতৃত্বের স্থলে বিশুদ্ধবাদী তাওহিদপন্থী মুখলিস দাওয়াতি নেতৃত্বের তত্বাবধানে যেনোতা প্রচলিত হয়। যেনো আমাদেরকে নতুন

কোনো ব্যর্থ প্রজেক্টের মুখোমুখি হতে না হয়। আপনার প্রশ্নে উত্থাপিত শরিআহ আদালত আমাদের প্রস্তাবিত সেই ইসলামাইজেশানের একটা অংশ হতে পারে।তবে প্রজ্ঞার দাবী হবে প্রথম পর্বে ক্রিমিনাল আইনে শরিআহ প্রতিষ্ঠা না করে সিভিল আইন পর্যন্ত শরিআহ আদালতকে সীমাবদ্ধ রাখা। আর আপনি যে বাংলাদেশের গ্র্যান্ড মুফতির কথা বলেছেন তার প্রয়োজন রয়েছে। তবে তিনি হবেন আবুল ফজল নন, মুজাদ্দিদে আলফে সানির ভূমিকায়।

●সম্প্রতি মুলধারার সেক্যুলাররা সংবিধান কমিশন গঠন করবার প্রস্তাব করেছে৷ রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন তাদের সংবিধানের রূপরেখা দিচ্ছে৷ পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্মের পর আমরা দেখি সকল ধারার উলামায়ে কোরামপীর মাশায়েখরা পাকিস্তানের সংবিধানে হাকিমিয়্যা সহ ইসলামি কানুন যুক্ত করতে ইশতেহার দিয়েছিল। মাওলানা সুলাইমান নদভির পেশকৃত ঐতিহাসিক ২২ দফার কথা স্মরণ করা যেতে পারে। সংবিধান কমিশন গঠন হলে সকল ধারার উলেমায়ে কেরাম-পীর মাশায়েখসহ ইসলামপন্থী দলগুলোর একক ইশতেহার দেওয়া উচিত কিনা? শাপলার ১৩ দফাতেও আমরা দেখি সংবিধান, আইনসংক্রান্ত আলাপ আছে। এ বিষয়ে আপনার ভাবনা যদি জানাতেন৷

●●আমি আবার বলতে চাই আমাদের চিন্তা-প্রবণতা হওয়া চাই দাওয়াতি। এমন এক শক্তিশালী প্লাটফর্মের দাওয়াহ যা সরাসরি রাষ্ট্রের এলিটকে নবুওয়তি মানহাজের ধারায় আকিদার জায়গা থেকে সম্বোধন করবে। তার বিপরীত কমিশন গঠন, ইশতেহার ঘোষণা ইত্যাদি এইসব হলো পলিটিক্যাল কর্মকাণ্ড—মূল সুন্নাহ নয়। আপনি কার কাছে প্রস্তাবনা দিবেন? এস্টাবলিশমেন্টের লোকজন তো ইমানদার নাহ। তাদেরকে ইমানের পথে ফিরিয়ে আনাটাই নবিদের বিপ্লবী দাওয়াতে মূল এথিক্স ছিল। আমাদেরকে তাই করতে হবে। হ্যাঁ, আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক মুরোদ জানান দেওয়ার জন্য এবং শিক্ষিত সমাজে আমাদের স্মার্ট সচেতনতার বার্তা পৌঁছানোর জন্য এমন ইশতেহার ঘোষিত হতে পারে ও কমিশনগঠিত হতে পারে৷ জাস্ট একটি বুদ্ধিবৃত্তিক প্রোপাগাণ্ডা৷ আমাদের মূল ফোকাস হবে বাস্তববাদী দাওয়াহ।

●ঔপনিবেশিক সময়ে মওলানা ইসমাঈল হোসেন সিরাজি এবং মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী সাধারণ মুসলিম কৃষকদের পাট ব্যবসাকে মাড়ওয়ারি, গুজরাটিদের হাতে ছেড়ে না দিতে বলেছিল। বাংলা অঞ্চলের মুসলিমদের ব্যবসার দিকে আরও জোর দিতে বলেছিল। উনাদের এই পরিকল্পনার মাকাসিদ ছিল অর্থনৈত্তিক মুক্তি। চামড়াশিল্প কি একক সিন্ডিকেটের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়ে গেল? এছাড়া কওমি মাদরাসা গুলো কি জমি ক্রয় করে তাতে ফসল উৎপাদন, গরু-ছাগল পালনের মাধ্যমে অর্থনৈতিকদিক বিবেচনা করতে পারে? তালিবুল ইলমরা-ই সেই জমিতে চাষ করল, গরু পালন করল। এখনকার কাওমি মাদরাসাগুলো অনেকটা ভাসমান৷ উত্তর-বাংলায় দেখায় যায় খ্রিস্টান মিশনারীর দাওয়াতি মেহনত। কিন্তু সেখানে তেমন মাদরাসা নেই। স্থানীয়রা দীন থেকে দূরে৷ পতিত জমিও পরে আছে অনেক। কওমি মাদ্রাসার বিকেন্দ্রীকরণ হলে কেমন হবে? আপনার মূল্যায়ন যদি জানাতেন।

●●রাজনৈতিক প্রস্তাবনার পাশাপাশি আমার নিজস্ব কিছু অর্থনৈতিক প্রস্তাবনা আছে। আপনি প্রশ্নে যতগুলো বিষয় উল্লেখ করেছেন তার সবই আমি সমর্থন করি এবং সময়োপযোগী বলে মনে করি। তবে আমার প্রধান প্রস্তাবটি হলো দেশব্যাপী সর্বত্র আলেমদের নেতৃত্বে সামাজিক উদ্যোগে যাকাত ব্যাংক প্রতিষ্ঠা। এই বিষয়ে আমার আরও বিস্তারিত আর্টিকেল রয়েছে।

●শাহবাগ আন্দোলন নিয়ে shahabagI secular কথাসাহিত্যিক শাহাদুজ্জামান ‘শাহবাগ ২০১৩’নামে একটা বই লিখেছিলেন৷ বইয়ে উনি কওমি মাদরাসার সংস্কার করার প্রস্তাব করেন।তবে এই সংস্কার বাইরে থেকে তারা করতে আগ্রহী না। কারণ এর ফলে হিতে বিপরীত হবে৷ তাই তারা চায় কওমি মাদরাসার মধ্য থেকেই এই সংস্কারের ডাক উঠুক৷ অরাজনৈতিক হওয়ায় মূলধারা সেক্যুলার সমাজ কাওমি মাদরাসা পড়ুয়াদের আপন করতে আগ্রহী। আমরা দেখি শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চাকরা কওমি মাদরাসার তালিবুল ইলমরা মূলধারার সেক্যুলার সমাজের সাথে এমনভাবে রিশতা রাখে তা অনেকটা গোলাম-মনিব মডেল। উৎপাদিত জ্ঞানের খরিদদার হওয়া দোষের নয়। কিন্তু কওমি মাদ্রাসার এই ধারার তরুণরা যতটা না জ্ঞান নিয়ে আগ্রহী, তার অধিক প্রদর্শন বিদ্যায় আগ্রহী। তারা সেক্যুলারদের স্বীকৃতি নিয়ে জাতে উঠার জন্যে উন্মত্ত। গত এক দশকের জুলুমের কারণে জামায়াতের মধ্যেও একরকম একটা ধারা তৈরি হয়েছে। হীনমন্যতায় আক্রান্ত এই উভয় ধারা সেক্যুলার সমাজের পাইক-পেয়াদা হিসেবে হাজির হচ্ছে৷ এই হীনমন্যতার কারন কি ?

●●এখানে আপনি যাদের কথা উল্লেখ করেছেন তারা আমাদের জন্য একটা বিষফল স্বরূপ। তবে তাদের এইপ্রয়াস হালে পানি পাবে না এবং ইসলামপন্থার মূলধারাকে তারা কখনও প্রভাবিত করতে পারবেনা। তবে ইসলামের লেবাসে সংস্কারের নামে সেক্যুলারিজমের যে বীজ বপিত হচ্ছে তাকে অঙ্কুরেই বিনাশ সাধন করতে হবে। জোর খাটিয়ে নয়—তাওহিদবাদী বুদ্ধিবৃত্তিক বয়ান দ্বারা।

●শাপলার আন্দোলনের সময় আপনার দায়িত্ব কি ছিল? চট্টগ্রাম-সিলেট-ঢাকার দায়িত্বে কারা ছিল? ৬ ই এপ্রিল এবং ৫ ই মেনিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা যদি জানাতেন৷

●●এই প্রশ্নের উত্তরটি অনেক লম্বা। সে এক বিশাল কারগুজারি, যা অন্য অধিবেশনে পেশ করব ইনশাআল্লাহ।অধিকন্তু (প্রকাশিতব্য শাপলানামার)স্মৃতি গদ্যের সাক্ষাৎকারে আমি অনেক কারগুজারি শুনিয়েছি।

●রাজনীতিও ক্ষমতাকে বাদ দিয়ে শুধুই অরাজনৈতিক দাওয়াতি-চ্যারিটি মডেল, একইসাথে বিদ্যমান ক্ষমতাও রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জের জায়গায় শুধুই কথিত কালচারাল ওয়ার মডেলসমাজ ও রাষ্ট্রকে অধিক সেক্যুলারয়ানের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। একই সাথে ইসলামপন্থা রাজনীতির বিরোধিতার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক ভাবেপ্রাতিষ্ঠানিক বি-ইসলামিকরণ(De- Islamization) আমরা দেখতে পাই। এই সেক্যুলারয়ান( Secularization) এর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজ করে দাওয়াতি মডেল এবং কালচারাল ওয়ার মডেল৷ হুমাইয়ারা ইক্তেদারের শব্দে বললে,এই ধারাগুলো অফিসিয়ালি সেক্যুলারইজমের বিরোধিতা করে, আবার একই সাথে সেক্যুলারয়ান (Secularization) এর সহায়ক শক্তি হয়ে সেক্যুলারইজমকে সমাজে শক্তিশালী ভাবে জারি রাখে। বাংলাদেশে আলেম সমাজ ও শাহবাগ-শাপলা উত্তর যে নয়া হিদায়তিবর্গ (দীনি ফেরা জনগোষ্ঠী) আমরা দেখি, এই উভয়বর্গই সমাজ এবং রাষ্ট্রকে অধিক সেক্যুলার করে তুলছে। আমরা এদেরকে তাহাজ্জুদ গুজারি এবং মুজাহিদ সেক্যুলার বলতে পারি কিনা? তালাল আসাদ ইসলামপন্থার রাজনীতি বাদ দিয়ে এই ধরণের অরাজনৈতিক সামাজিক আন্দোলন করতে উৎসাহ দিয়েছিলেন৷ একই সাথে বাংলাদেশের মূলধারার সেক্যুলাররাও এটা চায়৷ কারণ এতে ক্ষমতার লড়াই করতে হচ্ছে না। আপনাদের কি তালাল আসাদ এবং

মূলধারা সেক্যুলার সমাজ কখনো অনুপ্রেরণা হিসাবে ছিল কিনা এই অরাজনৈতিক দাওয়াত-চ্যারিটি মডেল এবং কালচারাল ওয়ার মডেল গ্রহণ করতে? এ বিষয়গুলো নিয়ে আপনার চিন্তা যদি শেয়ার করতেন৷

●●আমাদের তালাল আসাদের প্রয়োজন নেই। আমাদের রয়েছেন একজন আবুল হাসান আলি নদভি। তার সাথে আমরা দেওবন্দের সামাজিক ও শিক্ষা আন্দোলন এবং ইখওয়ানের সূচনা লগ্নের বিপ্লবী বয়ানকে সমন্বয় করে একটা বাস্তববাদী নতুন বিপ্লবী হাইপোথিসিস নির্মাণ করতে চাই। এটা কোনো চ্যারিটি মডেল নয় এবং বিপ্লব বিবর্জিত নিরীহ দাওয়াতি মডেলও নয়। এবং নিছক কোনো কালচারাল ওয়ার মডেলও নয়। এটি হলো একটি তাওহিদবাদী আইডিওলজি ও সুন্নাহ-সিরাতবাদী এপ্রোচ এবং সমকালীন ইসলামি জাগরণের প্রাণপুরুষদের চিন্তা-চেতনার সমন্বয়বাদী একটি সর্বাঙ্গীণ বিপ্লবী পরিকল্পনা। যার শুরুটা সমাজ-সংস্কৃতি, দাওয়াহ এবং শেষটা রাজনৈতিক বিপ্লব। এজাতীয় চিন্তা প্রাথমিকপর্বে সেক্যুলারদের কে কিছুটা নিরাপদ তন্দ্রা দিবে। তবে এইটাতে কোনো সেক্যুলারায়নের সম্ভাবনা নাই বরং সেক্যুলারদেরকে তাদের অবচেতনে জয় করার এক সুপ্ত পরিকল্পনা। এইসব বিষয়ে আমি আমার চেতনার ইশতেহার বইয়ে আলোচনা করেছি।

●অতীত ইতিহাসে আমরা বাম দলগুলো হতে উপদলের জন্ম দেখেছি৷ একইভাবে আমরা দেখেছি ইসলামি দল গুলোহতেও নানা উপদল তৈরি হয়েছে। গত কয়েক বছরের সে অস্থিরতা আমরা দেখলাম তাতে কি হেফাজতে ইসলাম হতেও এরকম অরাজনৈতিক উপদলের যাত্রা হবে? একজন তৌহিদি জনতা হিসাবে জানানোর অনুরোধ।

●●হেফাজতে ইসলামে এমন কোনো উপদলের জন্ম হলে তা হবে অত্যন্ত অশুভ। অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে এই বিষয়েআমরা যথেষ্ট সতর্ক রয়েছি।

●বিদ্যমান বাস্তবতায় আমাদের বাংলাদেশের উলামায়ে কেরামকি‘থানভি-উসমানি স্কুল অফ ইসলামিইজম’থেকে অধিক‘মাদানি স্কুল অফ সেক্যুলারইজম’এ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন?

●●থানবি-উসমানিস্কুল অব ইসলামিজম বনাম মাদানি স্কুল অব সেক্যুলারিজমে কোনো সংকট আছে বলে মনে হয় না।

●উপনিবেশের শুরুর দিকে বাংলায় সশস্ত্র আন্দোলন গুলোর ব্যর্থতা দেখা যায়। ফকির সন্নাসী-সাঁওতাল বিদ্রোহ-তিতুমীর ও হিদায়েতি বিদ্রোহ।এ থেকে একজন সমরনায়ক এই শিক্ষা নিবেন যে—বাংলার ভৌগলিক-রাজনৈতিক অবস্থার কারণে প্রতিবেশির সাহায্য ছাড়া সশস্ত্র আন্দোলন হালে পানি পাবে না। উল্টো বি-রাজনীতিকরণ করতে সহায়ক হবে। এই নিয়ে আপনার মতামত শুনতে আগ্রহী।

●●বর্তমান সময়কালের সংকটকে আমরা পুরো উম্মাহর সংকট হিশেবে দেখি—অর্থাৎ গ্লোবাল সংকট। আর তার সামরিক পন্থায় সমুচিত জবাব দেয়ার জন্য একটা গ্লোবাল তায়েফায়ে মানসুরার অস্তিত্বও দৃশ্যমান।সুতরাং মুসলিম উম্মাহর বর্তমান সামরিক লড়াইয়ের চরিত্রটা হলো বৈশ্বিক। তাই বাংলার ভৌগোলিক অঞ্চলকে এই বিষয়ে আলাদা করে সুনির্দিষ্টভাবে আলাপ হাজির করার প্রয়োজন নেই এবং

তার পসিবলিটিও বিদ্যমান নেই। এখানে জোরদার করতেহবে ইসলামি দাওয়াহকে এবং খালিস দাওয়াহ ভিত্তিক রাজনীতিকে।

●আবুলহাসান আলি নদভি যে কুতুব এবং মাওদুদি—উভয়ের হাকিমিয়্যার ক্রিটিক করছেন তা কিভাবে মল্যায়ন করবেন? অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইসলামিক স্টাডিজের শিক্ষক ওসামা আল আযমি তার" Locating Hakimiyya in Global History : The Concept of Sovereignty in pre- morden Islam and it’s Reception after Mawdudi and Qutub " আর্টিকেলে দেখান নদভি মাওদুদিকে অধিক রাজনীতিতে জোর দেওয়া নিয়ে ক্রিটিক করেছেন কিন্তু হাকিমিয়্যাকে অস্কীকার করে নাই৷ পাকিস্তানের সংবিধানে হাকিমিয়্যা নিয়ে মুজাহাদা -মেহনত ও জমিয়েতে উলামায়ে ইসলাম করেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশের উলামায়ে কেরামের কেউ কেউ এবং তরুন প্রজন্ম বলছেন, তাওহিদুল হাকিমিয়্যা শুধুই মাওলানা মাওদুদির প্রস্তাব। এই আংশিক পাঠ কে কিভাবে দেখেন? নদভির স্যায়িদ কুতুবের সমালোচনা নিয়ে আপনার মুল্যায়ন জানতে চাই৷

●●আমি আজ থেকে আরও আনুমানিক ৩০ বছর আগে সাইয়েদ আবুল হাসান আলি নদভি লিখিত ‘আত তাফসিরুস সিয়াসিলিল ইসলাম ফি কুতুবিল উস্তায আবুল আ’লা মওদুদি ওয়া সাইয়িদ কুতুব’বইটি পড়েছিলাম। তিনি আসলে সেখানে হাকিমিয়্যার ক্রিটিক করেননি। বরং ওসামা আল আযমি যেমন বলেছেন নদভি মওদুদিকে অধিক রাজনীতিতে জোর দেওয়া নিয়ে ক্রিটিক করেছেন কিন্তু হাকিমিয়্যাকে অস্বীকার করেন নাই। আজ থেকে ৩ দশক আগে মরহুম নদভির মাওলানা মওদুদির সমালোচনামূলক বইটি অধ্যয়নের সময়ই ড.জামাল আব্দুল আজিজসহ আরও বিভিন্ন মুসলিম স্কলারদের লিটারেচার পড়ার সুযোগ হয়েছে আমার। যেখানে তারা নদভির উক্ত অবস্থানকে খণ্ডন করেছেন। গত কয়েকদিন আগেও একটি ভিডিওতে দেখতেপেলাম পাকিস্তানের প্রফেসর ড. ইসরার আহমদ আল্লামা আবুল হাসান আলী নদভির উক্ত অবস্থানের সমালোচনা করে তিনি এজাতীয় মতামতকে ড. ওয়াহিদুদ্দিন আহমদ খানের মতামতের কাছাকাছি নিয়ে গেছেন।

আমার পর্যবেক্ষণ হলো—বিংশ শতাব্দীতে সাম্রাজ্যবাদের বিদায়ের পর মুসলিম দেশে দেশে যে পুনর্জাগরণ তৈরি হয় তার মূল বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষবাদের বিরুদ্ধে কঠোর আদর্শিক ও রাজনৈতিক অবস্থান। এটা ছিল সময়ের একটা স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। কারণ সাম্রাজ্যবাদ কঠিনভাবে মুসলিমদেশে দেশে সেক্যুলারিজমের-জাহিলিয়্যার বীজ বপন করে গিয়েছিল। যেই সেক্যুলার জাহিলিয়্যার প্রধান মধ্যমনি ছিল পাওয়ার বা ক্ষমতার এস্টাবলিশমেন্ট। যার বিরুদ্ধে একটি প্রতিক্রিয়া স্বাভাবিক বিষয় ছিল। মওদুদি এবং সাইয়িদ কুতুব তা-ই করেছেন। কিন্তু তারা দাওয়াতি সংস্কারমূলকভাষার চেয়ে রাজনৈতিক বিপ্লববাদের ভাষায় বেশি কথা বলেছেন। আর এই জায়গাটাতে মাওলানা নদভি আপত্তি তুলেছিলেন। তিনি সেই সময়ের ইসলামি আন্দোলনকে সময়ের পূর্বে ময়দানে অবতীর্ণ হওয়ার নামে অভিহিত করেছেন। তিনি ইসলামের বৈপ্লবিক রাজনৈতিক ধারার বিকল্পে মুজাদ্দিদে আলফেসানির আধ্যাত্মিক সংস্কারবাদী ধারাকে প্রমোট করেছেন। বিষয়টির উদাহরণ আমাদের অতীত ইতিহাসে সালাফের সময়কাল থেকে পরবর্তী সময়কাল পর্যন্ত মুসলিম সমাজে নানা ভ্রান্ত দল-উপদলের আবির্ভাবএবং তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার সাথে তুলনা করা যেতে পারে। যেমন ধরুন,ইমাম আবু হানিফাকে লড়তে হয়েছিল খারেজিদের বিরুদ্ধে। তাঁর সেই কঠিন খাওয়ারেজ বিরোধী ল্যাঙ্গুয়েজকে তাঁর সমালোচকরা ইরজার দিকে

নিয়ে গেল। এইভাবে ধরুন,মুহাদ্দিসদেরকে লড়তে হয়েছিল আকিদার বিভিন্ন প্রশ্নে মুতাজিলাদের বিরুদ্ধে। তাঁদের সেই অবস্থানকে তাদের সমালোচকরা মুশাব্বাহাদের কাতারে নিয়ে গেল। মাওলানা মওদুদি ও সাইয়িদ কুতুবের রাজনৈতিক ধর্মনিরপেক্ষবাদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক ইসলামপন্থার আওয়াজকে অনেকেই সমালোচনা করে তাঁদের মানহাজকে নবুওয়তি মানহাজের বিরুদ্ধে দাঁড় করান। তাদের মধ্যে ড. ওয়াহিদুদ্দিন খান অন্যতম এবং আরও রয়েছেন সুফিজমের প্রবক্তারা। এবং রয়েছেন জিহাদ ও বিপ্লব বিবর্জিত মিশনারি দাওয়াতের কিছু মুখলিস ধারা। আমি মনে করি আবুল হাসান আলি নদভি তাদের অন্তর্ভুক্ত নন। তিনি শুধু এতটুকু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন যে, দাওয়াতে রাজনীতির ভাষা নয়। তিনি দরদ নিয়ে বলতেন যে, ইখওয়ানুল মুসলিমিনকে এই দাওয়াহ বিবর্জিত রাজনীতি এবং প্রত্যাশিত সময়ের পূর্বে বৈপ্লবিক অবস্থান তাদেরকে বিপদের মুখোমুখি করবে। এই দায়ভার তাদেরকে নিতেই হবে। এখানে যেসমস্ত লোক তাওহিদুল হাকিমিয়্যার একক প্রবক্তা হিশেবে মাওলানা মওদুদি ও কুতুবকে হাজির করে তাদেরকে একঘরে করার চেষ্টা করেন, তাদের নিয়ত খারাপ। তারা সেক্যুলার শক্তির পরিবেশগত বিজয়ে কোণঠাসা হয়ে পরাজয়ের মানসিকতা লালন করেন। তাদের এই অবস্থানকে আবুল হাসান আলি নদভির অবস্থানের সাথে তুলনা করা যায় না।

●মাওলানা আহমদ শফি রহ., মাওলানা জুনায়েদ বাবুনগরি রহ. নুর হোসেন কাসেমি রহ: শাপলার এক দশকে চলে গেলেন। উনাদের সাথে আপনার স্মৃতি, উনাদের আপনার প্রতি নসিহত, উনাদের চিন্তা পদ্ধতি-সমাজ এবং রাষ্ট্র ভাবনা নিয়ে জানতে আগ্রহী।

●●আল্লামা আহমদ শফি, জুনায়েদ বাবুনগরি এবং নূর হোসাইন কাসেমি রহ সম্পর্কে এতটুকু বলাই যথেষ্ট যে, তাঁরা আপোষহীন ও নিরীহ সেই দেওবন্দ আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় একেকটা মাইলস্টোন। আল্লামা আহমদ শফি রহ সরাসরি আমার শিক্ষক এবং তাঁর সাথেই আমার সর্বাধিক সোহবত ছিল। প্রায় তিন দশকের সম্পর্ক। দু'টো জিনিশ তাঁকে উচ্চতায় নিয়ে গেছে। এক. তাঁর মনের সরলতা ও বিনয়।দুই. নজিরবিহীন তাহাজ্জুদের এহতেমাম। স্মরণকালে এই অঞ্চলে এরকম নেতৃত্ব আর কারও প্রতিষ্ঠিত হয়নি। পক্ষান্তরে শাইখের শেষজীবনে আশেপাশের কিছু আপনচক্র —হাদিসের ভাষায় যাদেরকে বিতানায়েসূ বলা হয়—তাদের কারণে কিছু কলঙ্ক লেগে যায় হযরতের নামে। তুলনামূলক অধিক বিশুদ্ধ চিন্তা চেতনা লালন করতেন আল্লামা বাবুনগরি রহ। জিহাদি চেতনা এবং ইলমের গভীরতা এই দুইয়ের অপূর্ব সমন্বয় ছিল তাঁর সত্তার মাঝে। আহমদ শফি রহ এর জীবদ্দশায় তাঁর নেতৃত্বে জনপ্রিয়তা আকাশচুম্বী হয়। কিন্তু শাইখের মাঝে ছিল সাংগঠনিক দুর্বলতা।

আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমির সাথে আমার সরাসরি যোগাযোগ খুব বেশি ছিল না। আমি তার মধ্যে গভীর তাকওয়া লক্ষ করেছি। আমানতদারি, সত্যবাদীতা এবং বিনয় তার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। ব্যক্তিচরিত্রে তাঁরা আমাদের জন্য অনুকরণীয় এবং সত্যি কথা বলতে বর্তমানে তাদের নজির অপ্রতুল। আর আপনি সমাজ এবং রাষ্ট্র ভাবনা নিয়ে তাদের বিষয়ে যে জানতে চেয়েছেন সে ব্যাপারে বাস্তবসত্য হলো তারা প্রত্যেকেই আমাদেরকে একটা মৌলিক অধিকার সংক্ষিপ্ত চেতনা দিয়ে গেছেন, কিন্তু দ্বীন সামগ্রিক কোনো শক্তিশালী বিশুদ্ধবাদী মানহাজ ও প্রকল্প দিয়ে যেতে সক্ষম হননি।

●দাওয়াতি-ইসলাহি কাজ করে কি রাজনীতি করা যায় না? মুশাহিদ বায়ামপুরি হুজুর পাকিস্তান আমলে এসেম্বলি তে ছিলেন৷ যতটুকু জানি উনি মাদানি হুজুরের মুরিদ ছিলেন। উনাকে নিয়ে যদি আপনার মূল্যায়ন জানাতেন৷

●●দাওয়াতি-ইসলাহি কাজের সাথে রাজনৈতিক সমন্বয়ের নজির পুরো দেওবন্দ আন্দোলনের শুরু থেকে এই পর্যন্ত অন্যতম বৈশিষ্ট্য। আপনি শুধু একজনের কথা বলেছেন। এর নজির তো ভুরিভুরি। হ্যাঁ, স্বীকার করতেহবে দুটি ভুল প্রবণতাও বর্তমানে সক্রিয়। এক. দাওয়াহ-ইসলাহ বিবর্জিত রাজনীতি। দুই. রাজনীতি বিবর্জিত দাওয়াহ-ইসলাহ।

●হোসাইন আহমদ মাদানি রহ: ‘মুত্তাহিদা কাওমিয়াত’এবং শাব্বির আহমদ উসমানির রহ:‘নয়া মদিনা’ নিয়ে আপনার ভাবনা জানতে আগ্রহী।

●●হোসাইন আহমদ মাদানি রহ এর মুত্তাহিদা কওমিয়্যাহ ছিল নিতান্তই গভীর রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অংশ এবং কৌশল মাত্র। এটা কোনো ভাবেই তার আকিদা ও চেতনার অংশ ছিল না। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুত্ববাদএবং বৈশ্বিক লিবারেল বিশ্বশক্তির মোকাবেলায় মুসলমানদের জন্য কৌশলের প্রথম স্টেইজ হিশেবে তিনি এই স্লোগান তুলেছিলেন। সুতরাং গভীর পর্যবেক্ষণে তিনি অতটা দোষী নন যেটা তার ব্যাপারে মনে করা হয়।

আর শাব্বির আহমদ উসমানি রহ এর যে নয়া মদিনার কনসেপ্ট, এটা আশলে হিন্দু রিবাইভালিজমের বিরুদ্ধে মন্দের ভালো হিশেবে পাকিস্তান আন্দোলনের ব্যাপারে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তী মুসলিমলীগের মুনাফেকি তিনি ধরে ফেলেছেন এবং তার পূর্বের কনসেপ্ট পরিত্যাগ করেছেন।

●শাব্বির আহমদ উসমানি রহ: হোসাইন আহমদ মাদানি রহ: এর তত্ত্বের নাকচ করতে গিয়ে উনার তত্ত্বকে আবুল ফজলের তত্ত্বের সাথে তুলনা করেন৷ একই সাথে উনি নিজেদের মানে যারা পাকিস্তান কায়েম করতে চাচ্ছে তাদের আহমদ সিরহীন্দির অনুসারী বলে পরিচয় দেন। শাব্বির আহমদ উসমানি রহ: এবং আশরাফ আলি থানভি রহ: কেন মুজাজিদ্দে আলফে সানিকে সামনে এনে বাস্তব বাদি দাওয়াতি মডেল নিলেন না? কেন উনারা নয়া ক্ষমতার অংশীদারত্বে গেলেন? উনারা কি বাস্তববাদি ছিলেন না? নাকি উনাদের মাঝে ক্ষমতার মোহ এসেছিল? ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ ইভেন্টগুলোতে আবুল ফজল,আহমদ সিরহীন্দির বাইনারির বাইরে গিয়ে মুজাদ্দিদে আলফে সানিরনন বাইনারি অবস্থান কতটুকু যৌক্তিক? স্যায়িদ নুরসি বা মুজাদ্দিদে আলফে সানি মডেল সকল সময়ের জন্য যৌক্তিক ভাবাটা কেমন?

●●আপনি বড়ই জটিল প্রশ্ন তুলেছেন। আমি আগেই বলেছি পাকিস্তান আন্দোলনের সপক্ষের উলামায়ে কেরামদের বাসনা অপূর্নই থেকে গেছে। একদিকে সাইয়িদ আহমদ শহিদের মুজাহিদ আন্দোলনের ব্যর্থতা, অন্য দিকে ইংরেজ পরাশক্তি ও আঞ্চলিক সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জাগরণবাদের মোকাবেলায় মুসলিম সমাজ ছিল অসহায়। তখন হঠাৎ করে মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজ থেকে মুসলিম লীগের উৎপত্তি ঘটে। তারা মুসলিম জাতীয়তাবাদের মুখ পূজক স্লোগান দেয়, হিন্দুত্ববাদের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠে এবং পাকিস্তানরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে শরিআহ কায়েমের ঘোষণা দেয়। উলামায়ে কেরাম বিশেষ করে থানবি ইশকুল অব থট এসব

কারণে মন্দের ভালো হিশেবে তাদেরকে বেচে নেওয়া ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। মুসলিম লীগের মুনাফেকদের বিষয়টি ছিল এসব উলামায়ে কেরামের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ। তারা নেজামে ইসলাম পার্টি নামক প্লাটফর্ম কায়েম করে উক্ত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য কিছুটা প্রয়াসপান। মুসলিম লীগের বিকল্প অধিক বিশুদ্ধবাদী ধারা হিশেবে নেজামে ইসলাম পার্টি তৎকালীন সময় পাকিস্তান সমাজে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি করে। কিন্তু পরবর্তীতে ইসলামি রাজনীতির এই এক্সপেরিমেন্টও তার জৌলুশ হারিয়ে ফেলে। দিনশেষে তাব্যর্থতা পর্যবেক্ষিত হয়। যদিও তা রাজনৈতিক কাঠামোতে যথেষ্ট ইসলামের চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়। কিন্তু নবুওয়তি মানহাজকে ফলো না করে প্রচলিতপশ্চিমা ধাঁচের রাজনীতির কারণে এই উলামায়ে কেরামগণ সমাজ রাষ্ট্রের বিবর্তনে কোনো ইসলামি বিপ্লব সাধন করতে পারেনি। এসব উলামায়ে কেরামদের পাকিস্তান রাষ্ট্রে তাদের ভূমিকাকে কোনো ভাবেই আবুল ফজল বলা উচিত হবে না। তাদের ভুলটা ছিল পদ্ধতিগত। কিন্তু তাদের ইখলাস, নিষ্ঠা ও চরিত্র ছিল সাহাবা সমতুল্য। তাদের সেই রুহানি উত্তরসূরী গণ আজ আফগানিস্তানে সফল ইসলামি রাষ্ট্র পরিচালনা করছেন। এই আলাপ অবশ্যই খুব জোরেশোরে উঠানো উচিত যে, এইপুরো অঞ্চলে ইসলামের সমাজ-রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য মুজাদ্দিদে আলফে সানির মডেলটি সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য। যিনি রাজ দরবারের তাগুতদের সাথে সংঘাতে না গিয়েও আপোষহীন এক সংস্কার কার্যক্রম গ্রহণ করেছিলেন এবং মূলধারার ইসলামপন্থায় বিরাজমান বিদাতে হাসানাকেও নাকচ করেছিলেন। পাকিস্তান আন্দোলন পরবর্তী সময়ে পুনর্গঠন প্রাক্কালে উলামায়ে কেরামের উচিত ছিল মুজাদ্দিদে আলফে সানির মডেলকে সামনে রাখা অর্থাৎ রাষ্ট্রযন্ত্রে আপোষহীন ইসলাহি কার্যক্রম গ্রহণ এবং সামগ্রিক ইসলামপন্থাকে বিদাতে হাসানা ও নানা তাওয়িলথেকে মুক্ত রাখা। আপনি জিজ্ঞেস করেছেন সাইয়িদ নূরসি বা মুজাদ্দিদে আলফে সানির মডেলসকল সময়ের জন্য যৌক্তিক ভাবাটা কেমন? তার উত্তরে বলব মুসলিম বিশ্বের আভ্যন্তরীণ কন্টেক্সটে এটাই সর্বোত্তম মডেল এবং এইটা এখনও যৌক্তিক ও প্রাসঙ্গিক। তবে বর্তমান সময়ের বৈশ্বিক কন্টেক্সটে সাইয়িদ আহমদ শহিদের সশস্ত্র মুজাহিদ আন্দোলনই আমাদের জন্য মডেল হতে পারে।

●পদ্ধতিবা মানহায নিয়ে বাম মহলেও এক সময় বাহাস ছিল। বাংলাদেশে জাসদ এবং সর্বহারার মতোন ইন্ডিয়াতেও সিপিআই এবং নকশালের আলাপ আনা যায়৷ ইসলামী ক্ষমতায়ন নিদিষ্ট মানহাযেই হতে হবে এটা বামপন্থীদের মানহাজ পূজার মতোন হয়ে যায় কিনা? একজন কমিউনিস্ট এই মানহাযপন্থীদের আপন ভেবে বলেছিলেন যে এরা কমিউনিস্ট সালাফি। আপনে এটাকে কিভাবে দেখেন?

●●পদ্ধতিও মানহাজের ক্ষেত্রে দুটি কথা মনে রাখতে হবে। প্রথমত, মৌলিকত্বের ক্ষেত্রে নবুওয়তি মানহাজই নির্দিষ্ট। এখানে কোনো পরিবর্তন কাম্য নয়। কুরআন ও সিরাতের বাইরে গিয়ে ইসলাম প্রতিষ্ঠারকোনো স্বপ্ন দেখা চিন্তা বিভ্রম ছাড়া কিছুই না। দ্বিতীয় কথা হলো,পদ্ধতি ও মানহাজ মৌলিকত্বের দিক থেকে সুনির্দিষ্ট হলেও তার অনুশীলনে পারিপার্শ্বিক বাস্তবতাকে আমলে নিতে হবে। এটা একটা ডাইনামিক ব্যাপার। স্থান-কাল-পাত্রের বিবেচনায় কৌশলে বিবর্তন আসতেই পারে। এইদুইটি বিষয়ে সমন্বয় রাখতে পারেনি বিংশ শতাব্দীর ইসলামের রাজনৈতিক ধারা। তারা হয়তো কৌশলের নামে মূল মানহাজকে পরিত্যাগ করেছে অথবা মানহাজকে একটি স্থির বিন্দু মনে করে আধুনিক পারিপার্শ্বিক উপকরণগুলোকে অস্বীকার করেছে। এসব বড় ক্রিটিক্যাল বিষয়। আপনাকে সাক্ষাৎকার দিয়ে নিছক

তাত্ত্বিক ভাষায় এসব বুঝাতে পারব না৷ আপনি প্র্যাক্টিক্যালি আমাদের সাথে কাজ করলে বুঝবেন আমরা কতটা বিশুদ্ধবাদী আবার সাথে সাথে কতটা কৌশলী।

●শাপলা ও শোকরানা এই বিষয়ে আপনার আলাপ শুনতে চাই।

●●শাপলাআমাদের চেতনার মাইলস্টোন। যদিও এখানে বিদাতে হাসানার মিশ্রণ ছিল। আর শোকরানা আমাদের নৈতিক স্খলনের দৃষ্টান্ত। যদিও সেখানে দাওয়ার কিছু সম্ভাবনা উঁকি মেরেছিল। আগামী দিনে এগোতে হবে শাপলার মাইলস্টোনকে আরও বিশুদ্ধবাদী রূপ দান করে এবং এগোতে হবে শোকরানার নৈতিক বিপর্যয় থেকে তাওবা করে তার দাওয়াতের খণ্ডিত অংশটুকুকে প্রজ্ঞার সাথে কাজে লাগিয়ে

●শাপলার বিপর্যয় মূলত বিজয়ই ছিলো। মৌলিকঅর্থে সাংস্কৃতিকভাবে, আমরা বিজয়ী হয়েছি।এ ব্যাপারে আপনি কী বলেন।

●●আপনারএই বক্তব্যের সাথে আমি একমত।

●ভবিষ্যতে বা বর্তমানে হেফাজতের অনিবার্যতা কতটুকু আছে? থাকলে হেফাজত তেরোর মতো আবার ফিরে আসতে পারবে কি না?

●●সাংস্কৃতিক মোকাবেলায় হেফাজতের অনিবার্যতা এখন অনস্বীকার্য। কেননা কালচারাল সেক্যুলারিজমের ফেনোমেনন বহাল তবিয়তে রয়ে গেছে। আর রাজনীতির ক্ষেত্রে ইমান-আকিদার প্রসঙ্গে একটা শক্তিশালী প্রেশারগ্রুপ হিশেবে হেফাজত এখন অপরিহার্য। তৃতীয়ত ভূ-রাজনৈতিক আধিপত্যবাদ ও ইসলামবিরোধী আঞ্চলিকনানা অপশক্তির উত্থানের চ্যালেঞ্জিং জায়গা থেকেও হেফাজত অঞ্চলের তাওহিদি জনতার একটি বড় ঠিকানা। এসব কিছুই হেফাজতকে এখনও অপরিহার্য রেখে দিয়েছে। কিন্তু আমি সাংগঠনিক দুর্বলতারকারণে বরাবরই এই সংগঠনের ভবিষ্যত সম্পর্কে শঙ্কিত।

●শাপলার চেতনাকে সাংস্কৃতিকভাবে টিকিয়ে রাখার জন্যকী কী উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে? আপনার কোন প্রস্তাবনাআছে কি না?

●●শাপলারচেতনাকে সাংস্কৃতিকভাবে টিকিয়ে রাখার জন্য প্রধান উদ্যোগ হিশেবে ব্যাপক ও বিস্তৃত আকারেদাওয়াতি কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। অধিক রাজনৈতিক ভাষা ব্যবহারের চেয়ে সমাজ বিপ্লবেরভাষা ব্যবহার করাই কাম্য। এখানে আমি সুনির্দিষ্টভাবে শিক্ষা সংস্কারের প্রস্তাবনাকে অগ্রাধিকার দিতে চাই। হেফাজতে ইসলামকে বড় ধরনের শিক্ষা পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। অন্যথায় আগামী দশকগুলোতে তার অব্যাহত মাশুল দিতে হবে।

আমি সর্বশেষ একটি তথ্য দিয়ে আমার এই পুরো সাক্ষাৎকার শেষ করতে চাই। আর সেটি হলো কারাগারে আমি হেফাজতে ইসলামের নতুন পুনর্গঠন নিয়ে একটি থিসিস তৈরি করেছি। যা উর্দু ভাষায় ইতোমধ্যে উলামাদের মাঝে বিতরণ প্রক্রিয়া শুরু করতে যাচ্ছি ইনশাআল্লাহ।●